বইয়ের নাম শুনেই এমন শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সবাই যে প্রকাশক-পাঠক, দোকানদার-পরিবেশক– এমন কোনও স্তরে কেউ ছিলেন না– যিনি অন্তত এই নামটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। প্রচণ্ড চাপের মুখে বইয়ের নাম বদলে করা হয় ‘হোয়াইট টিচার ইন আ ব্ল্যাক স্কুল’। কিন্তু কেন্ডাল তঁার কালো চামড়ার ছাত্রদের মন জানতেন। ঢেকে রাখা অথচ আদতে অসভ্যতার পুরীষ-স্তূপকে সরাসরি চিনিয়ে দেওয়ার পালটা-শিক্ষাই তারা বরাবর দিয়ে এসেছিল তাদের শিক্ষক, রবার্ট কেন্ডালকে। শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বিশেষ লেখা। লিখছেন ঋত্বিক মল্লিক।
‘কঙ্গোয় টিনটিন’। ১৯৩১ সালে সাদা-কালো রঙে-রেখায় ১১০ পৃষ্ঠার কমিক্স বইটি যখন প্রথম প্রকাশিত হয় ফরাসি ভাষায়, কিছু আপাতনিরীহ দৃশ্যাবলি আলগোছেই রয়ে গিয়েছিল সেই বইয়ে। সমালোচনার উত্তুঙ্গ নিশানায় উত্তাল হয়ে ১৫ বছরের মাথায় নতুন করে এঁকে, ছবি আর লেখা বদলে পুনঃপ্রকাশের পথে হঁাটতে হয় এ-বইকে। ১৯৭৫ সাল নাগাদ আবারও একবার বেশ কিছু বদল হওয়ার পরেও– আগের অভিযোগ যে সম্পূর্ণ মুছে ফেলা গিয়েছে– অতিবড় টিনটিন-ভক্তও সে-কথা খুব জোর গলায় বলতে পারেন না।
কী ছিল এ বইয়ে? একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। দৃশ্য: টিনটিন আচমকা পড়াতে ঢুকে পড়েছে কঙ্গোর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ক্লাসে। আফ্রিকার কালো ছাত্ররা সার দিয়ে বসে আছে ভূগোলের ক্লাসে। সামনে বোর্ডের উপরে ঝুলছে বেলজিয়ামের ম্যাপ, টিনটিনের হাতের পয়েন্টার সেদিকেই তাক করা। টিনটিন বলছে, ‘বন্ধুরা! আজ আমি তোমাদের পিতৃভূমি বেলজিয়াম সম্পর্কে কিছু কথা বলতে চলেছি।’
[আরও পড়ুন: আর জি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ, রাজ্য চরুকলা পর্ষদের সদস্যপদ ছাড়লেন সনাতন দিন্দা]
কঙ্গোর ভূগোল ক্লাসে বসে দেশের মানচিত্র দেখাতে গিয়ে কেন যে টিনটিনকে বেলজিয়ামের প্রসঙ্গ টেনে আনতে হল, ‘মাতৃভূমি’ না বলে ‘পিতৃভূমি’ শব্দটা বলার মধ্যে সেই ইঙ্গিত খানিক রয়েছে। কঙ্গো আসলে তখন বেলজিয়াম-অধিকৃত। ১৯০৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঔপনিবেশিক বিজয়ীর এই অধিকার নানাভাবে তার ক্ষমতা দেখিয়েছে নানা দিকে। কঙ্গোর স্কুলশিশুরা তাই নিজের দেশের ভূগোল বলতে চেনে শাসকের দেশের ভূগোল, নিজের দেশের ইতিহাস বলতে বোঝে শাসকের হাতে-লেখা শাসকের ইতিহাস। একদল কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রর মাঝখানে দঁাড়িয়ে শ্বেতাঙ্গ টিনটিন শ্রেষ্ঠত্বের দাপট ছড়াতে থাকে ক্লাসরুমে। আর তার পাশেই তার সাদা কুকুর স্নোয়ি, সে-ও রীতিমতো তুচ্ছ জ্ঞানে নানা ছুটকো মন্তব্য ছুড়ে দিতে থাকে ক্লাসভরা ছাত্রদের প্রতি, বেশ অবজ্ঞাই মিশে আছে তাতে। গায়ের চামড়ার রঙের এই তফাত ক্লাসরুমে ছাত্র আর শিক্ষকের মাঝখানে যে কী দুর্ভেদ্য পঁাচিল তৈরি করতে পারে, কত দূর চাপা টেনশন ছড়িয়ে দিতে পারে, অবিকল এই কমিক্সের পৃষ্ঠা থেকে উঠে আসা তেমনই এক বাস্তব উদাহরণ হয়ে থাকবে রবার্ট কেন্ডাল-এর গল্প।
জীবনের প্রথম চাকরি করতে গিয়েছিলেন কেন্ডাল। ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেসের যে স্কুল দু’টিতে কাটে তঁার প্রথম দু’-বছর, সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্রই ‘নিগ্রো’, কালো চামড়ার। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তখনও এসব শব্দ নিয়ে ছুঁতমার্গ রয়েছে প্রচুর, তবে চোরাস্রোতে। কেন্ডালের প্রথম চাকরিস্থল সম্পর্কে জানতে পেরে যেমন রীতিমতো রুখে দঁাড়িয়েছিলেন তঁার বোন হেলেন। ‘মারাত্মক ভুল করতে চলেছিস দাদা! তুই এখনই বোর্ডে জানিয়ে দে যে, তুই ওখানে যাবি না! বল যে তুই বাড়ির কাছাকাছি কোনও স্কুলেই চাকরি করতে চাস। যা খুশি কিছু একটা বানিয়ে বল তেমন হলে, কিন্তু নিজেকে এইভাবে উনুনে ফেলতে যাস না, তোকেই খেসারত দিতে হবে কিন্তু!’ বোনের এসব কথা খুব একটা গায়ে মাখেননি কেন্ডাল। এমনিতে যদিও হেলেন যে-পরিবেশে যেভাবে বড় হয়ে উঠেছিলেন, তার কোথাও এতটুকুও বর্ণবিদ্বেষের বাষ্প টের পাওয়া যায়নি। কেন্ডালের কথায় “It had never been ‘they’ or ‘them’ with her but always ‘he’ and ‘she’.” কিন্তু একবছর টানা কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্র অধ্যুষিত একটি স্কুলে পড়ানোর পর হেলেন যে অনেকটাই বদলে গিয়েছেন, সে-কথা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন তিনি। কিন্তু সেসব অপারগতার আক্ষেপকে হেলেনের ব্যক্তিগত ব্যর্থতা হিসাবে ধরে নেওয়ার বাইরে কেন্ডাল আলাদা করে এতটাও গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না যে, তার জন্য নিজের চাকরিস্থল বদল করতে হবে।
[আরও পড়ুন: পলিগ্রাফে দশ প্রশ্ন, লাই ডিটেক্টরের সামনেও সিবিআইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা সঞ্জয়ের]
কিন্তু শুধু একটা গোটা দিন শিক্ষক হিসাবে কাটানোর পর কেন্ডালের মনে হল, যে-মানুষটা স্কুলে জয়েন করেছিল, আর যে-মানুষটা প্রথম দিনের ক্লাসশেষে স্কুলের বাইরে এসে দঁাড়িয়েছে, তাদের মধ্যে যেন ৫০ বছর বয়সের তফাত। মাত্র একদিনের অভিজ্ঞতাই একেবারে স্থবির করে দিয়েছিল কেন্ডালকে। স্কুলে ঢুকেই প্রথমে অপ্রতিরোধ্য দুই যুদ্ধরত ছাত্রকে সামলাতে গিয়ে রীতিমতো হুমকির মুখে পড়েছেন একবার। প্রথম ক্লাস শুরু হওয়ার আগে পতাকা উত্তোলনের বঁাশি যখন বেজেছে, ছাত্রদের বেশিরভাগের মধ্যেই নড়াচড়ার কোনও লক্ষণ দেখতে না-পেয়ে পতাকার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রদর্শনের পদ্ধতি ও গুরুত্ব নিয়ে একটা গুরুগম্ভীর বক্তৃতাও দিতে বসেছিলেন, তঁার দিকে পিছনের বেঞ্চ থেকে উড়ে এসেছে একটা আধখাওয়া ফল। গোটা ক্লাস সমস্বরে ফেটে পড়েছে হাসিতে।
একটি ছেলে তো ক্লাসের মধ্যেই ইচ্ছাকৃতভাবে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকেছে, বেরিয়েওছে একইভাবে, গোটা ক্লাসপর্ব একটা হলুদ রঙের টেলিফোন ডাইরেক্টরির পাতা উলটেছে বসে বসে, কিছু বলতে গেলে নির্বিকার মুখে বিন্দুমাত্র পাত্তা না দিয়ে ঠিক সেটাই করে চলেছে, যেটা এতক্ষণ ধরে করছিল। অ্যাঞ্জেলিনা নাম্নী একটি মেয়ে ক্লাসে বসে মুখে কমপ্যাক্ট বুলিয়েছে, ঠোঁটে লিপস্টিক। সেসব বাজেয়াপ্ত করে তাকে প্রিন্সিপালের ঘরে পাঠানোর কথা বলতেই সে শাসিয়েছে চিৎকার করে, ‘এসব আমার সঙ্গে করতে আসবেন না বলে দিচ্ছি, আপনি নিজের কাজ করুন। আমাকে আমারটা বুঝে নিতে দিন।’ সারা দিন অপমানিত হতে হতে, চাপা রাগ আর ক্ষোভের উলটোমুখে দঁাড়িয়ে প্রত্যাখ্যানের রকমফেরগুলো বুঝে নিতে নিতে কেন্ডাল যখন দিনের শেষে প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে গিয়ে দঁাড়ালেন, তঁার আত্মবিশ্বাস বলে কিছুই আর তখন অবশিষ্ট নেই।
চাকরিটা হয়তো ছেড়েই দিতেন কেন্ডাল, যদি না ‘বিলি প্যারিশ’-এর সঙ্গে দেখা হত তঁার। ছোট্ট বিলি প্রথম দিনেই কেন্ডালকে বলেছিল, ‘আপনার মা-ও কি আমার মায়ের মতোই স্যর?’ প্রশ্নটা না-বুঝে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বাকিদের দিকে তাকাতেই সমস্বরে উড়ে এসেছিল উত্তর, ‘ওর মা তো পেশাদার বেশ্যা আসলে। সবাই জানে সে-কথা। আর নতুন কারও সঙ্গে দেখা হলে ও এই কথাটাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করে।’ চমকে উঠেছিলেন কেন্ডাল। তঁার মনে হয়েছিল, বড় বড় শান্ত চোখের এই খুদে বাচ্চাটার বোধহয় আরও অনেক কিছু বলার কথা জমে আছে বুকের মধ্যে। সেসব বের করতে না-পারা পর্যন্ত ছুটি নেবেন না কিছুতেই। এর পরের অধ্যায়গুলো আশ্চর্য! কেন্ডালের কাছে যেন গোটা স্কুল একদিকে, আর এই বিলি প্যারিশ আর-একদিকে। অল্পভাষী এই ছোট্ট ছেলেটার সঙ্গে ভাব জমাতে গিয়ে কখন যে আস্তে আস্তে তার বন্ধুরাও কেন্ডালের ছোট্ট গণ্ডিটাতে ঢুকে পড়ল, তা খুব ভালমতো ঠাহর করতে পারেননি কেন্ডাল।
শুধু এইটুকু বুঝেছিলেন, তঁার সাদা চামড়া অজান্তেই তঁার মনের ভিতরে গেঁথে দিয়েছে উচ্চমন্যতার নানাবিধ সংস্কার। সেই সংস্কারবশেই তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সহানুভূতি আর সমবেদনার বিজ্ঞাপন গলায় ঝুলিয়ে একদিন এই স্কুলটাতে পা রেখেছিলেন। শিক্ষার্থীর প্রতি শিক্ষকের স্বাভাবিক স্নেহের অতিরিক্ত আরও কিছু অবজ্ঞামিশ্রিত করুণাও কি মিশে ছিল না সেই প্রশ্রয়ের মধ্যে? তিনি যত নরম হয়েছেন তাদের প্রতি, যত ছাড় দিতে চেয়েছেন, যতবার নিজের স্বাভাবিক উচ্চতা থেকে আরও সহজতর যোগাযোগের লক্ষ্যে নিজেকে নামাতে চেয়েছেন আরও কয়েক ধাপ, ততবার তঁার প্রতি পদক্ষেপে সংকোচ বোধ করেছে তারা। তঁার করুণা নয়, বরং বিরোধও তাদের কাছে কাঙ্ক্ষিত। কিন্তু সে-কথা বোঝার কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না কেন্ডালের এত দিনের জীবনে। অবজ্ঞা আর ঘৃণা পেয়ে আসার দীর্ঘ ইতিহাস যে কীভাবে একটা দলগত যৌথ সামাজিক নির্জ্ঞান তৈরি করে দিতে পারে মানুষের অবচেতনে, তা একেবারে অনুপুঙ্খ সারাৎসার তুলে তুলে দেখিয়েছেন কেন্ডাল। তঁার ছাত্ররা বরং প্রশ্রয় চায়নি, শাসন চেয়েছিল; ছাড় চায়নি, চ্যালেঞ্জ চেয়েছিল; অকারণ স্নেহের ছদ্মবেশে করুণা চায়নি, সমান শক্তিতে মাঠে নামার ছাড়পত্র চেয়েছিল।
এসব কথা কেন্ডাল লিখে গিয়েছেন তঁার জীবনের এই আশ্চর্য দ্বিবার্ষিক অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘নেভার সে নিগার’ বইয়ে। বইয়ের নাম শুনেই তখন এমন শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল সবাই যে, প্রকাশক-পাঠক, দোকানদার-পরিবেশক– এমন কোনও স্তরে কেউ ছিলেন না যিনি অন্তত এই নামটা নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। প্রচণ্ড চাপের মুখে বইয়ের নাম বদলে করা হয় ‘হোয়াইট টিচার ইন আ ব্ল্যাক স্কুল’। কিন্তু কেন্ডাল তঁার ছাত্রদের মন জানতেন। উপর-উপর ধামাচাপা দিয়ে ফিসফাস করে ঢেকে রাখা অথচ আদতে অসভ্যতার এই পুরীষ-স্তূপকে সরাসরি চিনিয়ে দেওয়ার পালটা-শিক্ষাই তারা বরাবর দিয়ে এসেছিল তাদের শিক্ষক, রবার্ট কেন্ডালকে। সে-কথা কেন্ডাল ভোলেননি। তাই অচিরেই বইয়ের মূল নাম ফিরিয়েও এনেছিলেন।
আর, শুধু কালো ছাত্রদের স্কুলের জন্যই নয়, সারা জীবনের জন্য এই কথা ক’টা গেঁথে নিয়েছিলেন মাথায়– ছোট বলে অকাতরে বিলিয়ে দেওয়া স্নেহের মধ্যেও কখনও কখনও অবহেলার চিহ্ন থেকে যায়। ছাত্র আর শিক্ষকের মধ্যে সেই সাম্য অকারণ প্রশংসা নয়, ধরে রাখতে হয় স্বীকৃতি দিয়ে।