বীর দাসের ‘দুই ভারত’ বক্তব্যে বিরাট চটেছে গেরুয়া শিবির। চটাই স্বাভাবিক। বিদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কমেডিয়ান বীর দাস বলেছেন, ‘আই কেম ফ্রম টু ইন্ডিয়াজ’। একথা সত্যি হলেও মুখে আনা ‘অন্যায়’। লিখছেন কিশোর ঘোষ
বীর দাস (Vir Das) যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল দুই ইন্ডিয়ার একটি হল ভারত, অপরটি ইন্ডিয়া। একটি ভারত ফুটপাথবাসী, আরেক ইন্ডিয়ার প্রতিনিধিরা কেউ কেউ ধনকুবেরও বটে। বীর সরাসরিই বলেছেন, ‘‘আমি এমন ভারতের বাসিন্দা, যেখানে আমরা দিনে নারীদের পুজো করি, রাতে তাঁদেরই গণধর্ষণ করি।’’ শুধু তা-ই নয়, করোনার বিরুদ্ধে লড়াই, কৃষি আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, এমন একাধিক জ্বলন্ত সমস্যার কথাও তুলে ধরেছেন বীর। পাকিস্তান ও ক্রিকেট নিয়ে দ্বিচারিতাও তুলে ধরেছেন বীর তাঁর শো শেষের মনোলগে। যা অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছে প্রবল অস্বস্তির। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর পর্যন্ত করেছে বিজেপি নেতারা।
দু’দিন আগে একটি সর্বভারতীয় টিভি চ্যানেলে এই বিষয়ে সান্ধ্য আলোচনা চলছিল। সেখানে ছিলেন এক পেশাদার কমেডিয়ানও। তাঁর বক্তব্য, আমরা একই পেশায় আছি, কিন্তু ভারত নিয়ে এই ধরনের বক্তব্য মেনে নেওয়া যায় না। ভারতের কি সবই খারাপ? গর্ব করার মতো কিছু নেই! বিবেকানন্দের (Swami Vivekananda) কথা বলতেই পারতেন বীর।
না, বীর দাস বিবেকানন্দ-রবীন্দ্রনাথ-গান্ধীর কথা বলেননি। এমনকী গডসের কথাও বলেননি তিনি! তবে কিনা ওয়াশিংটন ডিসির কেনেডি সেন্টারে যে ভঙ্গিতে বক্তব্য রেখেছেন বীর- “আমি এসেছি সেই ভারত থেকে…”, এই ভঙ্গির সঙ্গে বিবেকানন্দের শিকাগো বক্তৃতার বাচন ভঙ্গিমার আশ্চর্য মিল রয়েছে! বাকিটা অবশ্যই অমিলের। কারণ বিবেকানন্দ মহান ভারতীয় সংস্কৃতির কথা বলেছিলেন। কেমন মহান? বিবেকানন্দের কথায়, “হে আমেরিকাবাসী ভগিনী ও ভ্রাতৃবৃন্দ… সর্বধর্মের যিনি প্রসূতি-স্বরূপ, তাঁহার নামে আমি আপনাদিগকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।”
[আরও পড়ুন: কৃষি আইন প্রত্যাহার নির্বাচনী চাল, না কি বোধোদয়?]
একই বক্তৃতায় একাধিকবার ধর্মান্ধতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। আশ্চর্যের হল যাঁরা প্রবল রাষ্ট্রবাদী, দেশের দুর্নাম করায় যাঁদের রাতের ঘুম ছুটেছে, তাঁরা বিবেকানন্দের নাম তুলছেন বটে, তাঁরাই আবার বীরের কুৎসা গাইতে গিয়ে তাঁকে ‘পাকিস্তানি মুসলিম’ বলে দেগে দিচ্ছেন! উইকিপিডিয়ায় (Wikipedia) বীর দাসের সম্পর্কে অশ্লীল ভুয়ো তথ্য সংশোধন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিচ্ছেন তাঁরাই। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে বিবেকানন্দের সর্বধর্ম সমন্বয়ের দর্শনের কোনও মিল নেই। যা তিনি বিশ্বমঞ্চে বুক ফুলিয়ে বলেছিলেন ১২৮ বছর আগে। প্রশ্ন হল, বীরের বিষয়ে বলতে গিয়ে এতসব তত্ত্বের কচকচি আসছে কেন? কী এমন অন্যায় করেছেন তিনি?
বড় অন্যায় করেছেন। সত্যি বলার চেয়ে বড় অন্যায় সভ্য পৃথিবীতে নেই! পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ, আমরা সবাই অভিনেতা। শেক্সপিয়র বুঝিয়ে ছিলেন বহু বছর আগে। সভ্য মানুষ হাড়ে হাড়ে জানেও সে কথা। শিশু, পাগল আর উচ্ছন্নে যাওয়া কতিপয় সৃষ্টিশীলরাই কেবল একথা ভুলে যায়। বীর দাস এদের মধ্যেই পড়েন বলেই মনে হয়। না হলে এত সাহস হয় কী করে তাঁর! এর বাইরে মাঝেসাঝে সত্যি বলে ফেলেন রাজনীতিবিদরাও। তাঁদের ক্ষেত্রে সেটা ভোটে জেতার ভীষণ প্রয়োজন। যেমন, কৃষি আইন প্রত্যাহারের পরে বিজেপি নেতা বরুণ গান্ধী (Varun Gandhi), পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী চরণজিৎ সিং চান্নির (Charanjit Singh Channi) মতো অনেকেই প্রধানমন্ত্রী মোদিকে (PM Narendra Modi) বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কৃষক আন্দোলনে ৭০০ কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। আগেভাগে আইন প্রত্যাহার হলে মানুষগুলো বেঁচে যেত। আমরা সাধারণ মানুষ, আমরাও তো চুপি চুপি প্রশ্ন তুলতে পারি, নোটবন্দির সময় শ দেড়েক মানুষ যে মরল, কেনও মরল? মনে করতে পারি, সেই যে দেশে করোনা আসার পর দুম করে লকডাউন হল। গোটা দেশে অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক আটকে পড়ল এখানে সেখানে। শেষে খেতে না পেয়ে তাঁরা হাজার দু’হাজার কিলোমিটার হাঁটা দিল। তাঁরা তো ঘরে ফিরে মরতে চেয়েছিল, বিদেশ বিভুঁইয়ে নয়। কিন্তু পথেই মৃত্যু হল বেচারাদের কারও কারও! যদিও যখন লকডাউন হয়েছিল তখনও পর্যন্ত করোনার তত প্রকোপ ছিল না। যখন প্রকোপ বাড়ল তখন লকডাউন তুলে নেওয়া হল! কেন?
[আরও পড়ুন: সংঘ পরিবারের হিন্দুত্বের ‘বিকল্প’ আদর্শ কি আদৌ তুলে ধরা সম্ভব কংগ্রেসের পক্ষে?]
কিন্তু এইসব সত্যি বলা বারণ। যদিও মানুষ মাত্রই ভাল-মন্দের ঠিকানা, দেশ-রাজ্যের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। আলো-অন্ধকারই সনাতন দুনিয়ার চিরকালের নিয়ম। কিন্তু হিরক রাজা এসব পছন্দ করেন না। উলঙ্গ রাজাকে উলঙ্গ বলা মহা অন্যায় কাজ ! মনে রাখতে হবে, যাতে দেশের ভাল হয়, রাষ্ট্রের ও শাসকের তাতে মন্দ হতেই পারে! এবং প্রয়োজন পড়ে মগজ ধোলাইয়ের। কিন্তু যন্তরমন্তর ঘরে সকলেই ধরা দেন না, হয়তো যাঁরা ধরা দেন না তাঁদেরই কারো কারো নাম গোপাল ভাঁড়, বীরবল, বীর দাস প্রমুখ!