shono
Advertisement

Ukraine Crisis: যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা

ভারতও কি মার্কিন চাপে যুদ্ধোন্মাদনা বাড়ানোর খেলায় শামিল হতে বাধ্য হল?
Posted: 01:46 PM Feb 22, 2022Updated: 01:46 PM Feb 22, 2022

কূটনীতির আবর্তে যুদ্ধের আশঙ্কা যখন কমছে, তখন ভারত কেন ইউক্রেনে বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে ফেরাতে উদ্যোগী, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। ইউক্রেন সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠায় আমেরিকা-ইউরোপের প্রাকৃতিক গ‌্যাসের বাজারে কিছুটা থাবা বসিয়েছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ইউরোপে যুদ্ধোন্মাদনার পিছনে কী মার্কিন স্বার্থ কাজ করছে। ভারতও কি তাহলে মার্কিন চাপে যুদ্ধোন্মাদনা বাড়ানোর খেলায় শামিল হতে বাধ্য হল?

Advertisement

সুতীর্থ চক্রবর্তী: অবশেষে ভারত সরকার ইউক্রেনে (Ukraine Crisis) বসবাসকারী ভারতীয়দের দেশে ফিরে আসার জন‌্য পরামর্শ দিয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া তিনদিন বিশেষ বিমান চালাবে বলে ঘোষণাও করেছে। কিয়েভ থেকে বিমান ভারতীয়দের নিয়ে দিল্লি ফিরবে। ভারত সরকার কি এই পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব দেরি করে ফেলল? এই প্রশ্ন সংবাদমাধ‌্যমে অনেকে তুলতে শুরু করেছে। যখন আমেরিকা বারবার মার্কিন নাগরিকদের ইউক্রেন থেকে ফেরানোর জন‌্য অ‌্যাডভাইসরি দিচ্ছিল, তখন নয়াদিল্লি চুপ করে বসেছিল। এখন যখন কূটনীতির আবর্তে ইউক্রেনের আকাশ থেকে যুদ্ধের কালো মেঘ ধীরে হলেও কাটার ইঙ্গিত মিলছে, তখন কেন হঠাৎ তড়িঘড়ি নয়াদিল্লি অ‌্যাডভাইসরি ও বিশেষ উড়ান নিয়ে কিয়েভে হাজির হল?

ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে হাজার হাজার ভারতীয় পড়ুয়া রয়েছে। এই পড়ুয়ারা যে নয়াদিল্লির অ‌্যাডভাইসরি পেয়ে দিল্লির উড়ানে উঠে বসবে–এমনটা মোটেও নয়। সংবাদমাধ‌্যমে বা হোয়াইট হাউসের প্রেস ব্রিফিংয়ে ইউক্রেন নিয়ে উত্তাপ যতই ছড়াক না কেন, শান্ত এই দেশটিতে কোভিড অতিক্রম করে আপাতত জোরকদমে এগিয়ে চলেছে লেখাপড়া। ইউক্রেনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ‌্যালয়ে অফলাইনেই পড়াশোনা চলছে। সময়ে ডিগ্রি পেতে গেলে এখানে অফলাইন ক্লাস মিস করার কোনও সুযোগ নেই। পারসেন্টেজ থাকতে হবে ১০০ শতাংশ। রাশিয়া লাগোয়া ডনবাস অঞ্চল ছাড়া যখন বাকি ইউক্রেনের বাতাসে একফোঁটা বারুদের গন্ধ নেই, তখন খামোকা ভারতীয় পড়ুয়ারা লেখাপড়া অনিশ্চিত করে কেন দিল্লির পরামর্শ শুনে দেশের উড়ানে উঠে বসবে?

 

[আরও পড়ুন: আনিস হত্যার তদন্তে গাফিলতির অভিযোগ, সাসপেন্ড আমতা থানার ৩ পুলিশকর্মী]

সর্বশেষ ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম‌্যাক্রো-র সঙ্গে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘ টেলিফোনের কথোপকথন যথেষ্ট আশার সঞ্চার করেছে কূটনৈতিক মহলে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তাঁর গোয়েন্দাদের খবরের সূত্রে যতই ইউক্রেনে রুশ হামলার বিষয়ে নিশ্চিত হন না কেন, যুদ্ধের আশঙ্কা ইউরোপীয়দের মধ্যেও তেমন নেই। বাইডেন ও পুতিনের মধ্যে আলোচনার বিষয়ে তাঁরা অনেক আশাবাদী। ডনবাস অঞ্চল থেকে বহু ইউক্রেনের নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে রাশিয়ায় গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে। এরা উদ্বিগ্ন ইউক্রেনীয় সেনার প্রত‌্যাঘাত নিয়ে। পূর্ব ইউক্রেনের এই ডনবাস এলাকা রুশ-অধ্যুষিত। এই রুশ বংশোদ্ভূতরা আশঙ্কা করছে জাতিগত হামলার। ফলে, বারুদের গন্ধ আপাতত শুধু ইউক্রেনের এই অঞ্চলেই সীমিত। আমেরিকার বরাবরের অভিযোগ, পূর্ব ইউক্রেনের এই অঞ্চলে ছায়াযুদ্ধ চলছে সরাসরি পুতিনের মদতে। গত কয়েক দিন ডনবাস অঞ্চলে যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে, তার অনিবার্য পরিণতি হল রুশ হামলা। ইউক্রেনে হামলা চালানোর জন‌্য এইভাবেই প্রেক্ষিত নির্মাণ করছে রাশিয়া। এটাই যুক্তি ওয়াশিংটনের।

আমেরিকার এই বক্তব‌্যকে রাশিয়া আগেও উড়িয়ে দিয়েছে। এখনও উড়িয়ে দিচ্ছে। বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে গ‌্যাস পাইপলাইন, যা ‘নর্ড স্ট্রিম’ হিসাবে পরিচিত, তা যে এই সম্ভাব‌্য যুদ্ধের প্রতিরোধক হিসাবে কাজ করছে, তা নিয়ে বিশ্বের বড় অংশের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞর কোনও সংশয় নেই। বস্তুত, আমেরিকার নিশানাতেও এই ‘নর্ড স্ট্রিম’। গত সেপ্টেম্বরেই ‘নর্ড স্ট্রিম ২’পাতার কাজ শেষ হয়েছে। রাশিয়ার সীমান্ত থেকে যে পাইপলাইন বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে ফিনল‌্যান্ড, পোল্যান্ড ও সুইডেনের গা ঘেঁষে জার্মানিতে গিয়ে উঠেছে। গোড়া থেকেই এই পাইপলাইন প্রকল্পের তীব্র বিরোধী ছিল আমেরিকা। ওবামা বিরোধিতা করেছেন। তারপর ট্রাম্প বিরোধিতা করেছেন। এখন বাইডেনও এই পাইপলাইনের বিরোধী।

ঘনিয়েছে যুদ্ধের মেঘ

ইউক্রেন সীমান্তে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠায় আমেরিকা ইউরোপের প্রাকৃতিক গ‌্যাসের বাজারে কিছুটা থাবা বসিয়েছে। ফলে বোঝাই যাচ্ছে, ইউরোপে যুদ্ধোন্মাদনার পিছনে মার্কিন স্বার্থ কী কাজ করছে। রাশিয়া ইউরোপ জুড়ে প্রাকৃতিক গ‌্যাস বিক্রি করে। রুশ অর্থনীতি এখন এই গ‌্যাস বিক্রির উপরই দাঁড়িয়ে। রুশ গ‌্যাসের উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল জার্মানি। জার্মানদের ঘরে ঘরে যে রান্নার গ‌্যাস পৌঁছয়, তা এই পাইপলাইনে বাহিত হয়ে রাশিয়া থেকে আসে। ইউক্রেনকে পাশ কাটিয়ে জার্মানি-সহ ইউরোপের বিস্তীর্ণ বাজারে প্রাকৃতিক গ‌্যাস পৌঁছে দিতে বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে পাতা এই পাইপলাইন রাশিয়ার কাছে এখন বিরাট হাতিয়ার। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ ইউক্রেনের স্বার্থকে বিঘ্নিত করছে। তাদের জমির উপর দিয়ে যাওয়া রাশিয়ার গ‌্যাস পাইপলাইন থেকে মোটা টাকা ভাড়া আদায় করে ইউক্রেন। রাশিয়া তাদের পুরো প্রাকৃতিক গ্যাসটাই বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে ইউরোপে পাঠাতে শুরু করলে ইউক্রেনের বিরাট আর্থিক ক্ষতি।

মোদ্দাকথা, ইউরোপে যে প্রাকৃতিক গ‌্যাসের চাহিদা রয়েছে, তার ৪১ শতাংশ এখন পূরণ করছে রাশিয়া। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ রাশিয়ার এই বাজারকে আরও প্রশস্ত করবে। আমেরিকা এতেই ঘোর বিপদসংকেত দেখছে। রাশিয়াকে উদ্বেগের মধ্যে ঠেলে দিয়ে ইউক্রেনকে ‘ন‌্যাটো’-য় অন্তর্ভুক্ত করা মার্কিনি চাপের পিছনেও যে এই ইউরোপের বিশাল প্রাকৃতিক গ‌্যাসের বাজারের দখলদারির খেলা আছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। পশ্চিম এশিয়ায় তেলের বাজার ধরতে আমেরিকা যুদ্ধ করে ইরাক, আফগানিস্তানে। ঠিক একইভাবে প্রাকৃতিক গ‌্যাসের বাজার ধরতে এখন ইউরোপেও তারা যুদ্ধে আগ্রহী। জো বাইডেন তাঁর সাংবাদিক বৈঠকে সরাসরি হুমকি দিয়ে বলেছেন, ইউক্রেনে যদি রাশিয়া হামলা চালায়, তাহলে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ চালু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা থাকবে না। বাল্টিক সাগরের তলা দিয়ে ইউরোপের বাজারে অনেক সস্তায় রুশ কোম্পানিগুলি প্রাকৃতিক গ‌্যাস পাঠাতে পারবে– যা ইউরোপের বাজারে রাশিয়ার দখলদারি আরও সুদৃঢ় করবে। সেটা কেন মানবে ওয়াশিংটন? দ্বিতীয়ত, এই পাইপলাইনের মধ্য দিয়ে রুশ-জার্মানি যে অর্থনৈতিক অক্ষ গড়ে উঠতে পারে, তা আমেরিকার পক্ষে ইউরোপে প্রভাব বিস্তারে এক বড় বাধা।

[আরও পড়ুন: রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের আঁচ শেয়ার বাজারে, হুড়মুড়িয়ে পড়ল সেনসেক্স]

ইউক্রেনে রুশ হামলা হলে যে ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ চালুর উপর নিষেধাজ্ঞা চাপবে, সেই ইঙ্গিত আমেরিকার চাপে নয়া জার্মান চ‌্যান্সেলর ওলাফ শোল্টজ দিয়েছেন। শোল্টজের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার পর পুতিনের সুর অনেকটাই নরম হয়েছে। ‘নর্ড স্ট্রিম ২’ প্রকল্পটি দ্রুত চালুর ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিশাল বাণিজি্যক স্বার্থ। তাই পুতিন আপাতত কোনও হঠকারী সিদ্ধান্তের দিকে যাবেন না বলে ধরেই নেওয়া যায়। তবে স্নায়ুযুদ্ধ যে চলবে, তা স্পষ্ট। রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে, বেলারুশে তাদের মহড়া চলবে। বেলারুশে রয়েছে মস্কোপন্থী সরকার। ইউক্রেনের সঙ্গে বেলারুশের সীমান্ত ৬৬৫ মাইল দীর্ঘ। এই দীর্ঘ সীমান্তে গত কয়েক দিন ধরে মহড়া চালাচ্ছে ৩০ হাজার রুশ সেনা। তারা পারমাণবিক অস্ত্রপ্রয়োগের মহড়াও দিয়েছে।

মস্কো ও ওয়াশিংটনের এই স্নায়ুযুদ্ধ যে আগামী কয়েক দিনে বাড়বে, সন্দেহ নেই। কিন্তু তাতে এটা মনে করার কোনও কারণ নেই যে, যুদ্ধ অনিবার্য। ফলে ভারত কেন এখনই হাজার হাজার পড়ুয়ার লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দিয়ে তাদের দেশে ফেরাতে উদ্যোগী, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ভারতও কি তাহলে মার্কিন চাপে যুদ্ধোন্মাদনা বাড়ানোর খেলায় শামিল হতে বাধ্য হল?

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement