সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ইলেক্টোরাল বন্ড (Electoral Bond)। যা নিয়ে এই মুহূর্তে তোলপাড় জাতীয় রাজনীতি। বন্ডের মাধ্যমে অনুদানের সিংহভাগ পেয়েছে বিজেপি। অঙ্কটা প্রায় ৭ হাজার কোটি। বিরোধীদের দাবি, সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি এই নির্বাচনী বন্ড কেলেঙ্কারি। ঘুষ, তোলাবাজি, চাঁদার বদলে সুবিধা দেওয়া, বিজেপি নাকি সবই করেছে বন্ডের মাধ্যমে। পালটা বিজেপির দাবি, বন্ড পদ্ধতি আনাই হয়েছিল স্বচ্ছতার জন্য। এর মাধ্যমে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কালো টাকা কমানো গিয়েছে। ইতিহাস অবশ্য বলছে, নির্বাচনী অনুদান প্রক্রিয়ায় এই 'স্বচ্ছতা'র সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে কেন্দ্রের শাসকদলই। আর এই 'স্বচ্ছতা'র আনতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে বিজেপি সরকারকে। এমনকী উপেক্ষা করতে হয়েছে নির্বাচন কমিশন এবং আরবিআইয়ের মতো স্বশাসিত সংস্থার 'রেড ফ্ল্যাগ'কেও।
২০১৭ সালে বাজেট বক্তৃতায় তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি (Arun Jaitly) এই ইলেক্টোরাল বন্ড আনার কথা ঘোষণা করেন। ২০১৮ সাল থেকে এই বন্ড ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ইলেক্টোরাল বন্ড এক ধরনের দলিল। কোনও ব্যক্তি বা কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক দলগুলিকে চাঁদা দিতে চাইলে, তিনি ব্যাঙ্ক থেকে বন্ড কিনে রাজনৈতিক দলের হাতে তুলে দিতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টে সেই বন্ড ভাঙিয়ে নেয়। এই বন্ড কে বা কারা কিনছেন, তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণভাবে গোপন রাখা হয়। ১ হাজার, ১০ হাজার, ১ লক্ষ, ১০ লক্ষ ও ১ কোটি টাকা মূল্যের বন্ড পাওয়া যায়। সরকারের দাবি ছিল, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা কমাতে এবং অনুদানের মাধ্যমে কালো টাকার আদানপ্রদান রুখতে উপযোগী হবে ইলেক্টোরাল বন্ড। সরকারের দাবি ছিল, নগদে লেনদেন হলে বা রাজনৈতিক দলগুলি সরাসরি নগদে অনুদান নিলে এর মাধ্যমে অসাধু ব্যবসায়ীরা কালো টাকা সাদা করে ফেলছে।
[আরও পড়ুন: ‘তিহার জেলে স্বাগত’, কেজরিওয়ালকে আগাম অভ্যর্থনা ‘ঠগবাজ’ সুকেশের]
ইলেক্টোরাল বন্ড চালুর আইনি প্রক্রিয়া বেশ জটিল ছিল। মোদি সরকারকে সেসময় বন্ড চালুর জন্য চারটি আইন বদল করতে হয়। প্রক্রিয়া শুরু হয় ২০১৬ সালে। সে বছর ১৪ মে অর্থ আইনে সংশোধনী আনেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়, বিদেশি কোনও সংস্থা যদি ভারতীয় সংস্থার মাধ্যমে কোনও রাজনৈতিক দলকে চাঁদা দিতে চায়, তাতে কোনও আইনি বাধা থাকবে না। ওই অর্থ আইনেই ফের সংশোধনী আনা হয় ২০১৭ সালের মার্চ মাসে। এবার সংশোধনীতে বলা হয়, ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলগুলিকে কারা চাঁদা দিল, বা কত চাঁদা দিল, সেটা প্রকাশ করার প্রয়োজন পড়বে না। সেই একই সময় বদল আনা হয় RBI আইনেও। আগে দেশে মুদ্রা বা সমতুল কিছু ছাপা বা তৈরির অধিকার ছিল শুধু রিজার্ভ ব্যাঙ্কের হাতে। এই সংশোধনীতে বলা হল, কেন্দ্র চাইলে যে কোনও ব্যাঙ্ককে বন্ড ছাপার দায়িত্ব দিতে পারে। অর্থাৎ বকলমে টাকার বিকল্প হিসাবে বন্ড ছাপার অধিকার পেয়ে যায় স্টেট ব্যাঙ্ক। এসবের বাইরেও ইলেক্টোরাল বন্ড আনার জন্য কেন্দ্রকে বদল করতে হয় জনপ্রতিনিধি আইনও। কারণ জনপ্রতিনিধি আইন অনুযায়ীও, রাজনৈতিক দলগুলি কোন সংস্থার কাছে চাঁদা পাচ্ছে সেটা ঘোষণা করতে হত। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আইনের এই সংশোধনীগুলি অর্থ বিল হিসাবে রাজ্যসভায় পাশ করানো হয়। কারণ সেসময় রাজ্যসভায় বিজেপির সাংসদ সংখ্যা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল না।
[আরও পড়ুন: হিমাচলে নতুন ‘খেলা’, বিজেপিতে যোগ কংগ্রেসের ৬ বহিষ্কৃত বিধায়কের, পদত্যাগ ৩ নির্দলেরও]
এই চার আইন বদলের পরও আসে বাধা। দেশের নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপ যাদের তত্ত্বাবধানে হওয়ার কথা, সেই নির্বাচন কমিশন খোদ ইলেক্টোরাল বন্ডে আপত্তি জানায়। কমিশন সে সময় স্পষ্ট বলে দেয়, নির্বাচনী বন্ড চালু হলে গোপনীয়তার আড়ালে অস্বচ্ছ্বতা বাড়বে। তাছাড়া কমিশনের আপত্তির আরও একটা জায়গা ছিল বিদেশি সংস্থাকে অনুদানের সুযোগ দেওয়া। নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য ছিল, বিদেশি সংস্থাকে অনুদানের সুযোগ দিলে পরোক্ষে তারা ভারতীয় নির্বাচন প্রভাবিত করতে পারে। শুধু নির্বাচন কমিশন নয়, বন্ডের নিয়মে আপত্তি জানায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কও। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক ছাড়া অন্য কোনও ব্যাঙ্ককে বন্ড তৈরির অনুমতি দিলে পরোক্ষে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতীয় মুদ্রার উপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, আশঙ্কা করেছিলেন তৎকালীন আরবিআই কর্তারা। কিন্তু কেন্দ্র সেই সমস্ত আপত্তি উড়িয়ে নির্বাচনী বন্ড চালু করে দেয়। প্রশ্ন হল, কেন্দ্র নির্বাচনী ব্যবস্থায় ঠিক কোন স্বচ্ছতা আনার জন্য এত মরিয়া হয়ে উঠেছিল যে চার আইন বদল করে দুই স্বশাসিত সংস্থার আপত্তি তুড়িতে উড়িয়ে বন্ড ব্যবস্থা চালু করে দেওয়া হল?