shono
Advertisement

আকাশের মতো নীল স্বাধীনতা

কবীর সুমনের সাপ্তাহিক কলাম। The post আকাশের মতো নীল স্বাধীনতা appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 01:18 PM Aug 18, 2018Updated: 01:48 PM Aug 18, 2018

সাল ১৯৫৭ বড়জোর। ১৯৪৭ তার ঠিক ১০ বছর আগে। ফেলে দেওয়া লম্বা ঝুলঝাড়ুর ডান্ডায় লাগানো পতাকার সামনে আমাদের কথা চলছে এমন সময়ে ও-পাশের বাড়ির দোতলা থেকে আমাদের পাড়ার এক মামা জানালার রড ধরে আমাদের বললেন, ‘ওরে ছেলেরা, স্বাধীনতা আসে নাই রে, স্বাধীনতা আসে নাই। তোরা মিছামিছি এইসব করতাছিস।’ কবীর সুমন

Advertisement

‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছ অপমান
অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘বাইরে কোঁচার পত্তন
ভিতরে ছুঁচোর কেত্তন’

অন্নদাশঙ্কর রায়

৭০ হয়ে গিয়েছে। ভাবলে কেমন লাগে। ছেলেবেলাটা ছিল এই তো সেদিন। অথচ কতদূর। বয়স তখন বড়জোর ৮। আমাদের বাড়ির ছোট্ট উঠোনে কয়েকজন বন্ধু মিলে ১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবস করছি। একটা তেরঙ্গা পতাকা জোগাড় করে, ফেলে দেওয়া একটা লম্বা ঝুলঝাড়ার একদিকে অনেক কষ্টে ঢোকাতে পেরেছি আমাদের জাতীয় পতাকা। কিছু ইট জোগাড় করে এনে দাঁড় করাতে পেরেছি ডান্ডা। কিন্তু সে যখন-তখন পড়ে যেতে পারে। আমাদের মধ্যে কে একজন বলল, ‘জাতীয় পতাকা পড়ে গেলে খারাপ হয়।’ আমরা বললাম, ‘কার?’ সে বলল, ‘জাতির।’
‘জাতি মানে কী?’, সেই বন্ধুটি বলতে পারল না। বড়দের কাউকে জিজ্ঞেস করার ইচ্ছা নেই। আমরা ধস্তাধস্তি করছি ঝুলঝাড়ার ডান্ডায় জাতীয় পতাকা লাগাতে। বড়দের কেউ কেউ দেখছে জানালা দিয়ে, বারান্দা থেকে। কিছু বলছে না। আমাদের উদ্‌যাপনে বড়রা নেই। সাল ১৯৫৭ বড়জোর। ১৯৪৭ তার ঠিক ১০ বছর আগে।

[প্রথমত চাই আরও শান্তি-সারসওয়ালা]

পতাকা তো খাড়া। এবারে। এক বন্ধু বলল, ‘এই সময়ে গান গাইতে হয়।’ ‘কোন গান?’ আমরা ভাবছি পতাকার সামনে দাঁড়িয়ে। একজন বলল ‘বন্দে মাতরম্‌’ বলে চেঁচাতে হয়। অগ্নিযুগের বীর বিপ্লবীদের উপর কিছু বই আমার অল্প বয়স থেকেই পড়া ছিল। আমি বললাম, ‘ঠিক! বিপ্লবীরা ফাঁসি যাওয়ার আগে বন্দে মাতরম্‌ বলতেন।’ এক বন্ধু বলল, ‘বিপ্লবী মানে কী?’ ‘জাতি’-র মতো ‘বিপ্লবী’ কথাটারও মানে জানতাম না আমরা। এখন ফেসবুক করা সব বাঙালি জানে। ব্যাঙেরা রাস্তার মোড়ে সরকারবিরোধী মিটিং করছেন না বলে যাঁরা ফেসবুক ভরিয়ে দিয়ে থাকেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমনকী, তাঁর হাওয়াই চপ্পলজোড়াকেও গালাগাল দিয়ে তাঁরাই হলেন এখন মধ্যবিত্ত বাঙালি বিপ্লবী।

এক বন্ধু বলল, ‘কিন্তু আমাদের তো ফাঁসি হচ্ছে না, তাহলে আমরা কেন বন্দে মাতরম্‌ বলে চেঁচাব?’ ফেলে দেওয়া লম্বা ঝুলঝাড়ুর ডান্ডায় লাগানো পতাকার সামনে আমাদের কথা চলছে এমন সময়ে ও-পাশের বাড়ির দোতলা থেকে আমাদের পাড়ার এক মামা জানলার রড ধরে আমাদের বললেন, ‘ওরে ছেলেরা, স্বাধীনতা আসে নাই রে, স্বাধীনতা আসে নাই। তোরা মিছামিছি এইসব করতাছিস।’ আমাদের এই মামা আর তাঁর ছোট বোন, দু’জনেই প্রবীণ- সেকালের পূর্ব পাকিস্তান থেকে চলে এসেছেন এদিকে। মায়ের কাছে শুনেছি। খুবই সাধারণভাবে থাকেন। সুযোগ পেলেই মামা জানলায় ছোট একটা আয়না লাগিয়ে দাড়ি কামান আর তাঁর বোনের সঙ্গে কথা বলেন। এইদিনও তিনি জানলায় এসে দাঁড়িয়েছেন গালে সাবান মাখিয়ে ক্ষুর হাতে। জাতীয় পতাকার নিচে জড়ো হওয়া পাড়ার ছোটদের দেখতে পেয়ে হাঁক পাড়ছেন তিনি। এদিকে কোনও একটা বাড়ির বড় কেউ বেরিয়ে এসে বলছেন, ‘ছোটরা আজকের দিনে আনন্দ করছে, ওদের অন্য কিছু বলে কী লাভ!’ মামা- ‘অন্য কিছু কেন। এটাই তো হক কথা। কোথায় স্বাধীনতা! কার স্বাধীনতা! বড়লোকদের! গরিব তো সেই গরিবই থেকে যাচ্ছে গো!’

[প্রমাণ কই যে কান্দাহার থেকে আসোনি…]

সেই মামা ও তাঁর বোন এবং মামার কথায় আপত্তি তোলা পাড়ার সেই মাসি- কেউই আজ নেই। এ দেশের ১০০ জনের মোটামুটি ৭০ জন পেটভর্তি খিদে নিয়ে রাতে ঘুমতে যান। শতকরা ৮০টি পরিবার জানেন না জল সরবরাহ কাকে বলে। ৬৫ কোটি মানুষ নিজের নামও সই করতে পারেন না। দেশের মানুষের কয়েক হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে (খেলাপি ঋণ-ব্যাংক থেকে নেওয়া এবং ব্যাংককে ফেরত না দেওয়া), একটি বিমান সংস্থাকে বিজেপি ঘনিষ্ঠতার ফুঁয়ে উড়িয়ে দিয়ে এক ভারতীয় শ্রেষ্ঠী, যিনি আবার রাজ্যসভার সাংসদও ছিলেন, ভিনদেশি সমুদ্রসৈকতে সুন্দরীদের সঙ্গে এক্কাদোক্কা খেলে তোফা দিন কাটাচ্ছেন।

মাঝখান থেকে গরু চুরির মিথ্যে দায়ে সংখ্যাগুরুরা পিটিয়ে মারছেন সংখ্যালঘুদের। জনা পাঁচেক বিজেপিবিরোধী সাংবাদিককে বেবাক খুন করে দেওয়া হয়েছে। ধরা পড়েনি কেউ। মেয়েদের নিরাপত্তা ঘণ্টায় ঘণ্টায় কমছে। কমছে প্রবীণ নাগরিকদের আর্থিক নিরাপত্তাও- ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট ও সেভিংস ব্যাংকের সুদের হার কমছে ক্রমশ। আরও কমবে। কাশ্মীরে গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভারত সরকার সেই কোন কালে! কোথায় গেল সেই প্রতিশ্রুতি? ফলে কাশ্মীরিরা তাঁদের আত্মনির্ধারণাধিকার পেলেন না। পেলেন ভারত ও পাকিস্তানের নির্দয় ও সুবিধাবাদী রেষারেষির মধ্যে ছিন্নভিন্ন হওয়ার অধিকার। আর ভারতের বাহিনী অধিকার পেল শিশুদের টিপ করে বন্দুক দিয়ে পেলেট গুলি চালানোর। ৭০ পেরনো আমার বুড়ো কানে এখনও বেজে চলেছে ৮ বছর বয়সে ১৫ আগস্টে শোনা প্রতিবেশী এক প্রবীণের হাহাকার, ‘ওরে ছেলেরা, স্বাধীনতা আসে নাই রে, স্বাধীনতা আসে নাই।’

The post আকাশের মতো নীল স্বাধীনতা appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার