নির্মল ধর: একজন নমস্য বিশ্ববরেণ্য চলচ্চিত্রকারের প্রতি তাঁরই জীবনের সেরা ছবি তৈরির নেপথ্য কাহিনির চলচ্চিত্রায়ণে যে ধারাবাহিক সংগ্রাম,তৎকালীন স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সিনেমা বানানোর ব্যকরণটাকেই আমূল বদলে দেওয়ার চেষ্টা, প্রাচীন পন্থীদের অবজ্ঞা, অবহেলা উপেক্ষা করে, সত্যজিৎ রায় নামের তরুণের সঙ্গে সুব্রত মিত্র,বংশী চন্দ্রগুপ্ত সহ হাফডজন তরুণ যে অসাধ্য সাধন করেছিলেন তারই এক ডকুমেন্টেশন “পথের পাঁচালী” (Pather Panchali) তৈরির প্রায় ৬৬ বছর পরে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরলেন পরিচালক অনীক দত্ত।
শান্তিনিকেতন থেকে ছবি আঁকার পাঠ নিয়ে সত্যজিৎ যোগ দিয়েছিলেন বিজ্ঞাপন সংস্থার একজন শিল্পী হিসেবে। সেখানেই দিলীপ গুপ্তের নজরে পড়ে তাঁর প্রতিভার তুলির টান। বিভূতিভূষণের চিরন্তন উপন্যাস “আম আঁটির ভেঁপু”র অলঙ্করণ ও প্রচ্ছদ আঁকতে দেওয়া হয় তাঁকে। গ্রামীণ বাংলার পটভূমিতে কোনও লেখা পড়া সত্যজিতের সেই প্রথম। ততদিনে সিনেমার প্রতি তাঁর ও বন্ধুদের গভীর প্রেম তৈরি হয়েছে। নিজেরাই গঠন করে ফেলেছেন ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি, দেখে ফেলেছেন রাশিয়ান ক্লাসিক “ব্যাটেলশিপ পটেমকিন”। কোম্পানির কাজেই তাঁর সস্ত্রীক বিলেত যাওয়া এবং সেই যাত্রাপথেই উপন্যাসটির শুধু অলঙ্করণ নয়, নিজের মনের মত একটা স্টোরি বোর্ডও তিনি তৈরি করে ফেলেন সত্যজিৎ। আর ৬ মাস লন্ডনে থাকাকালীন বিভিন্ন দেশের ইউরোপীয় সিনেমা দেখে নিজের চোখ কান অন্যভাবে তৈরি করতে শুরু করেন। বিশেষ করে ডি সিকার “বাইসাইকেল থিবস” দেখে তাঁর সিনেমা দেখা ও বানানোর অন্যরকম চোখ তৈরি হয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: সম্পর্কের সূক্ষ্ম মুহূর্তগুলো তুলে ধরল দিতিপ্রিয়া-রেণুকাদের ‘স্টোরিজ অন দ্য নেক্সট পেজ’ ]
এরপর তো ছবির জন্য অর্থ জোগাড়ে তাঁদের কেমন নাজেহাল হতে হয়, প্রতিষ্ঠিত সিনেমাওয়ালারা কেমন ভাবে তাঁদের ব্যাকরণ ভাঙা ছবির জন্য অবজ্ঞা করে, সেসব কাহিনির বিবরণ খোদ সত্যজিৎ রায় তাঁর একাধিক নিজের লেখায় দিয়ে গিয়েছেন। স্ত্রী বিজয়া রায়ের আত্মকাহিনীতেও বিস্তৃত করা আছে পারিবারিক সংকটের কথা।
সেইসব জানা কাহিনির সঙ্গে কিছু অজানা কাহিনি জুড়েই অনীক দত্ত চিত্রনাট্য সাজান “অপরাজিত” ছবির (Aparajito Review)। কোথাও অতিকথন নেই, বাড়াবাড়ি নেই। সিনেমাজগতের আইন ও সম্ভ্রম মেনেই বদল ঘটানো হয়েছে সব বাস্তব চরিত্র এবং বইটির চরিত্রেরও। সত্যজিৎ হয়েছেন অপরাজিত, সুব্রত মিত্র হয়েছেন সুবীর, বংশী চন্দ্রগুপ্ত হয়েছেন চন্দ্রগুপ্ত কিচলু। এমনকী, নাম বদলে গিয়ে হয়েছে হরিহর, সর্বজয়া, দুর্গা, অপুর। বোরাল গ্রাম হয়েছে সরাল। না, তাতে দর্শকের এতটুকু বুঝতে অসুবিধে হবে না যে অপরাজিত রায়ের ছবি তৈরির লড়াই প্রকৃত অর্থে “পথের পদাবলী” নয়, “পথের পাঁচালী”র জন্য।
বিশিষ্ট সিনেমা ও নাট্যব্যক্তিত্ব শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখোমুখি বসে আকাশবাণীর কোনও এক রেকর্ডিং ঘরে অপরাজিত রায় তাঁর প্রথম ছবির সংগ্রাম ও সাফল্যের কথা বলছেন – এমনভাবেই ছবির শুরু। এই সাক্ষাৎকারের মাঝে মাঝেই ঢুকে পড়েছে অতীতের বিভিন্ন গল্প আর সেই গল্প বুননের মাধ্যমেই তৈরি হয়েছে চিরকালীন বিশ্ব ক্লাসিক তৈরির নেপথ্য ঘটনার এক দলিল। পরিচালক অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতার সঙ্গে সেইসব ঘটনাকে যেমন আজকের ডিজিটাল পদ্ধতিতে তুলে এনেছেন, তেমনি সিনেমার ভাষাকেও যথেষ্ট মর্যাদা দিয়েছেন।
“পথের পাঁচালী” ছবির আইকনিক কিছু দৃশ্যের শুটিং যেমন ইন্দির ঠাকরুণের মৃত্যু, বৃষ্টিতে অপু দুর্গার স্নান, দুর্গার মৃত্যু,দইওয়ালার সঙ্গে অপু দুর্গা ও একটা কুকুরের শট, এমনকী, মৃত ইন্দির ঠাকরুণের শেষ যাত্রার শুটিং নিয়ে হাসি মসকরার ব্যাপারগুলোও বাদ যায়নি। পর্দায় দৃশ্যগুলো এলে, পুরনো ছবির কথা মনে করেই দর্শক আপ্লুত হয়েছেন। ছবি নির্মাণের কৌশলে যে সব যুগান্তকারী পরিবর্তন এনেছিলেন সুব্রত মিত্র, তাঁর বাউন্সিং লাইটিং ব্যবহার, স্বাভাবিক আলোয় আউটডোর শুটিং করার সাহস, সেই অপু দুর্গার ট্রেন দেখার শটের অনিচ্ছাকৃত ভুল যে নতুন ব্যাকরণ তৈরি করে দিয়েছিল তারও উল্লেখ রয়েছে। “পথের পাঁচালী”র সঙ্গে মেলাতে বসলে সত্যিই অবাক হয়ে যেতে হয়, কি অসাধারণ ধৈর্য ও দক্ষতায় অনীক দত্ত নতুন করে তৈরি করেছেন অতীত। তুমুল বৃষ্টিতে ভাইবোনের ভেজার দৃশ্যটির শুটিংয়ে সত্যজিৎ নিজে থাকতে পারেননি, দু-তিনদিন অপেক্ষার পর হঠাৎ প্রচন্ড বৃষ্টি এসে পড়ায় সুব্রত মিত্র ও বংশী দুজনে মিলে শুটিংটুকু করেছিলেন। এতটাই ছিল তাঁদের শৈল্পিক বোঝাপড়া!
সেই বোঝাপড়ার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল তৎকালিন মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধান রায়ের মাধ্যমে সরকারি অর্থের যোগান। যেদিন প্রথম সরকারি চেক সত্যজিতের বাড়ি পৌঁছয়, সেইদিনই বিজয়া সত্যজিৎকে শোনান তাঁদের সন্তান আগমণের খবর! কলকাতায় মুক্তি পাওয়ার আগেই নিউ ইয়র্কে দেখানো হয় ছবিটি, দারুণ প্রশংসা পায় সুব্রত মিত্রের কাজ। পরে জহওয়ারলাল নেহরুর উদ্যোগে কান উৎসবে জিতে নেয় “বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট” ছবির পুরস্কার। সেই জয়যাত্রা আর থামেনি। কিন্তু এই কলকাতা শহরে প্রথমটায় তেমন সাড়া না ফেললেও এক ঝাঁক তরুণ প্রজন্মের উৎসাহে, নিন্দুকদের “বিদেশে দেশের দরিদ্র বিক্রির” অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে “পথের পদাবলী”র, থুড়ি পথের পাঁচালীর জয়যাত্রা আটকাতে পারেনি। শুধু বাংলায় নয়, ভারতীয় সিনেমায় এক নবদিগন্ত এনে দিয়েছিল “পথের পাঁচালী”। আর এতদিন পরে সেই ক্লাসিক নির্মাণের নেপথ্য কাহিনিকে পর্দায় ফিরিয়ে এনে এক ঐতিহাসিক দলিল রেখে গেলেন আজকের তরুণ পরিচালক অনীক দত্ত।
হ্যাঁ, এবার আসা যাক ছবির প্রধান চরিত্র অপরাজিত রায় বকলমে সত্যজিৎ রায় কতটা হয়ে উঠেতে পারলেন নতুন মুখ জিতু কমল। অভিনেতার শারীরিক গঠন, চলন, বলার ভঙ্গি, কিছু ব্যবহারিক প্যাটার্ন সুন্দর রপ্ত করেছেন জিতু। তাঁকে মেনে নিতে অসুবিধে হয়নি। বাকি ছিল অমন ব্যারিটোন কণ্ঠস্বর! সেটা কিছুটা সামলে দিয়েছেন চন্দ্রাশীস রায়। তবে জিতু কমলের চেহারায় সত্যজিতের ব্যক্তিত্ব, তাঁর ছোট ছোট অভিব্যক্তি সুন্দর এসেছে। সত্যজিৎ বলে মানতে খুব একটা অসুবিধে হয়নি। বিজয়া রায়ের চরিত্রে সায়নী ঘোষ যথেষ্ট সাবলীল। সুব্রত মিত্রর ভূমিকায় দেবাশিস রায়ও বেশ সুন্দর চালিয়েছেন। সুপ্রতিম ঢোলের চিত্রগ্রহণ, অর্ঘ্যকমল মিত্রর সম্পাদনা এবং সর্বোপরি দেবজ্যোতি মিশ্রর আবহ সৃজন তাঁর জীবনের অন্যতম একটি সেরা কাজ হয়ে রইল।
অনীক দত্তর (Anik Dutta) পাশাপাশি এই ছবির নির্মাণে আর্থিক সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য ফিরদৌসুল হাসানেরও। বাংলা সিনেমার এই ঐতিহাসিক দলিলে তাঁরা দু’জন একটি প্রমাণ রেখে গেলেন।