রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-উচ্চারিত ঘোষণা প্রতিদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় নতুন ভাবনার আলো ছড়ায়, কখনও রাজনীতির ক্ষেত্রে, কখনও সমাজ ও সংস্কৃতির পরিসরে, কখনও উন্নয়নের প্রসারী পরিকল্পনায়। কিন্তু গতকাল তাঁর মুখে উচ্চারিত হল সেই বহু অপেক্ষিত দৈববাণী, যার উপর তখুনি ঝরে পড়ল স্বর্গের ফুলচন্দন, যা শুনে আকাশ জুড়ে ধ্বনিত হল মঙ্গলশঙ্খ আর যার অভিঘাতে মুহূর্তে প্রসারিত নারীর স্বীকৃতি, সম্মান, শ্রদ্ধা ও তার প্রতিভার কাছে নতির অবিকল্প অঙ্গীকার! মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঐতিহাসিক ঘোষণা এক অসহায় নারীর অনেক দিনের পুরনো কান্না, বেদনা, অভিমান প্রশমিত করল। শুরু করল সমাজ-সংসারে নারীবন্দনার নতুন যুগ। সন্দেহ নেই এই ঘোষণায় জ্বলে উঠেছে নতুন সময়ের আলো। নতুন ভবিষ্যতের দিশা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টার থিয়েটারের নতুন নাম দিয়েছেন, ‘বিনোদিনী থিয়েটার’। এই একটি সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা মমতাকে জুড়ে দিল বাঙালির নতুন ইতিহাসের সবুজপত্রে! তিনি উড়িয়ে দিলেন নতুন সাহস ও সমাজদর্শনের বিজয়বৈজয়ন্তী পরিবর্তনের পরমলগ্নে! বাঙালি সংস্কৃতির যে-ইতিহাসে মমতা হয়ে উঠলেন এই দুঃসাহসী ঘোষণার সুবর্ণরেখা, তার কালো গল্পটিও বাঙালির জানা দরকার। সেই গল্প আমাদের নিয়ে যায় বহু বছর আগের এক দিনে, যেদিন বিখ্যাত নাট্যকার এবং অভিনেতা গিরিশচন্দ্র ঘোষ কিশোরী সুন্দরী অসাধারণ মঞ্চাভিনেত্রী বিনোদিনীকে এসে বলেন, কলকাতায় তৈরি হচ্ছে নতুন রঙ্গমঞ্চ। এবং রঙ্গমঞ্চ তৈরি করবে এক পাঞ্জাবি তরুণ তুর্কি! নাম গুর্মুখ রায়। গিরিশবাবু বিনোদিনীকে জানান, বিপুল বিত্তবান গুর্মুখ একটিই কারণে তৈরি করতে চলেছে এই রঙ্গমঞ্চ। এবং সেই কারণ, বিনোদিনী। বিনোদিনীর প্রেমে গুর্মুখ পাগল। এবং বিনোদিনীর নামেই সে তৈরি করবে থিয়েটার। বিডন স্ট্রিটে জমি নেওয়া হয়ে গিয়েছে। এবং সেখানেই হবে বিনোদিনী রঙ্গমঞ্চ! গুর্মুখ একটি শর্তে তৈরি করতে চলেছে এই রঙ্গমঞ্চ। সেই শর্ত হল, বিনোদিনীই হবে বিনোদিনী থিয়েটারের মালিক এবং অভিনেত্রী! এ তো অবাস্তব স্বপ্ন। বিশ্বাস হয় না বিনোদিনীর। গুর্মুখ নিজে জানায় তাকে, এই স্বপ্ন সে বাস্তব করবেই। এবং ঠিক হয়েছে সেই রঙ্গমঞ্চের নাম হবে, বিনোদিনী নাট্যমন্দির। এই নামটি নাকি স্বয়ং পছন্দ করেছেন গিরিশ ঘোষ। গুর্মুখের মনে হয়, নামটা যেন তেমন পছন্দ হল না বিনোদিনীর। তোমার অন্য কোনও নাম পছন্দ? বিনোদিনীর কাছে জানতে চায় গুর্মুখ। জানায় বিনোদিনী লাজুক উচ্চারণে : ‘স্টার বিনোদিনী থিয়েটার।’ বাঃ, খুব ভালো নাম। তোমার চেয়ে বড় অভিনেত্রী আর কে আছে বিনোদ? স্টার তো একজনই। বলে গুর্মুখ।
কিন্তু এই ঘটনার কয়েকদিনের মধ্যে গিরিশ গোপন মিটিং ডাকেন। সেই মিটিংয়ে উপস্থিত, অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়। এবং কুটিলবুদ্ধির ডাক্তার দাশুচরণ নিয়োগী। গিরিশই মূল বক্তা। তিনি বলেন, গুর্মুখ বিনোদিনীর জন্যে পাগল। শুনেছি ওকে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়েছে বিনোদকে গুর্মুখের সঙ্গে থাকতে হবে, এই দাবি করে। বিনোদ নাকি এই টাকা গুর্মুখকে ফেরত দিয়েছে। আমার বিশ্বাস হয় না। থিয়েটার পাড়ার মেয়ে টাকা ফেরত দেবে? অসম্ভব। যাই হোক, বিনোদ ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। নতুন রঙ্গমঞ্চের মালিক হবে ওই মেয়ে। ক্রমশ কিন্তু আমাদের পক্ষে সে এক বড় আপদ হবে। তাছাড়া ওর বয়স তেইশ হতে চলল। বাবুরা আর কতদিন সহ্য করবে ওই তেইশ বছরের বুড়িকে? আমরাও কি বিনোদ রঙ্গমঞ্চের মালিক হলে সেখানে সম্মানের সঙ্গে কাজ করতে পারব? ওর সামাজিক পরিচয় তো দেওয়ার মতো নয়। ওর নামে থিয়েটার হলে বাবুরা সেই থিয়েটারে আসবে না। বদনাম ছড়িয়ে পড়বে। বিনোদিনী দাসীকে গুর্মুখ রায় তার রক্ষিতা করে রাখলে তার সম্মান কিছু বাড়বে না।
গুর্মুখের টাকায় কিন্তু নতুন থিয়েটার তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেল। এবং বিনোদিনী নিজে হাত লাগাল সেই থিয়েটার তৈরির কাজে! সে মজুরদের সঙ্গে থিয়েটার তৈরির জমিতে মাটি ফেলতে শুরু করল। সে মজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ লাগিয়ে কাজ করতে লাগল। মাথায় করে ঝুড়ি ঝুড়ি বালি এনে ফেলতে লাগল ঠিক সেইখানে যেখানে তৈরি হবে থিয়েটারের অভিনয় মঞ্চ।
কিন্তু নতুন থিয়েটারের রেজিস্ট্রেশনের দিন বিনোদিনীর মাথায় বজ্রাঘাত করলেন গিরিশচন্দ্র ঘোষ। বললেন, বিনোদ একটা দুঃসংবাদ আছে। তোর নাম রেজিস্ট্রেশন করা যাবে না। বাবুরা প্রতিবাদ করছে শহরজুড়ে। বারাঙ্গনার নামে থিয়েটার হলে বাবুরা সেই থিয়েটারে আসবে না।
বিনোদিনী নতমস্তকে দাঁড়িয়ে রইল। চোখ থেকে কান্নাধারা। মুখে একটিও কথা নেই। কী অধিকারে কথা বলবে সে? সমাজ কি তাকে সেই অধিকার দিয়েছে?
গিরিশবাবু তাকে বললেন, একটা উপায় কিন্তু বার করেছি বিনোদ। থিয়েটারের নাম হবে, ‘বি’ থিয়েটার। বিনোদের ‘বি’ টা তো রইল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না।
সেই কথাও রাখেননি গিরিশবাবু। তিনি তাঁর, নতুন থিয়েটার দলের নাম রাখলেন, ‘ক্যালকাটা স্টার কোম্পানি।’ আর নতুন রঙ্গালয়ের নামটি মানানসইভাবেই হল, ‘স্টার থিয়েটার।’ কোথাও বিনোদিনীর নামগন্ধ রাখতে দিলেন না তিনি। তারপর তাড়িয়েও দিলেন বিনোদিনীকে সে তেইশ বছরের বুড়ি বলে। বাবুরা নাকি তাকে আর তেমন নিচ্ছে না।
১৮৮২-র আগস্ট মাসে, ঝুলনযাত্রার প্রথম দিন, ‘স্টার’ থিয়েটার শুরু করেছিল তার জয়যাত্রা, একটি মেয়ের হৃত সম্পদ ও সম্মানের উপর দিয়ে। ১৪১ বছর পরে, ২০২৪-এর শেষ দিনে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরিয়ে দিলেন কলকাতার মেয়ে বিনোদিনীকে তার প্রাপ্য সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও সুবর্ণস্বীকৃতি।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ না করে পারছি না এই বছর আজকাল-এর পুজো সংখ্যায় আমার লেখা উপন্যাস ‘স্টার বিনোদিনী থিয়েটার’-এর শেষটুকু।
‘আমার স্বপ্নের বাংলায় আরও একটি ঘটনা ঘটেছে। বাংলা শাসনের ভার গেছে এক নারীর হাতে। পুরুষ নয়। নারী। তাঁর কথাই শেষ কথা। তিনিই প্রেরণা। তিনিই চালিকা। এবং সেই অনন্যার প্রণোদনায়, প্রয়াসে, প্রোৎসাহে কলকাতার বুকে শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে এক নতুন সময় ও সমাজের নাট্যমঞ্চ!
নাম ‘স্টার বিনোদিনী থিয়েটার’! রোজ কত কী ঘটে যাহা তাহা। এমন যদি সত্যি হত আহা!’
সত্যি হল শেষ পর্যন্ত!