নির্মল ধর: পঞ্চাশ পেরিয়েও সাতের দশকের আগুনে ঝরানো সময়ের স্মৃতি বাঙালির মননে উজ্জ্বল। বিশেষ করে আলোকিত ‘সুশীল সমাজে’র মানুষদের সান্ধ্য ‘আহ্নিকে’র আসরে। কত প্রতিভা যে অঙ্কুরে বিনষ্ট হল, তা নিয়ে আক্ষেপ অন্তহীন। নকশাল আন্দোলন কেন দিকশূন্যপুরের কাহিনি হয়ে গেল? তা নিয়ে রীতিমতো তর্ক চলে নেশার ঘোর চরমে না পৌঁছানো পর্যন্ত। কিন্তু, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এতদিন পরে হলেও ওই আগুনে সময়টা এবং পরবর্তী প্রতিক্রিয়া নিয়ে এমন চিন্তা উদ্রেককারী ছবি বড় একটা দেখিনি, যেমনটি দেখাল দেবালয় ভট্টাচার্যের ‘ড্রাকুলা স্যার’ (Dracula Sir)। বাংলায় তো নয়ই!
সত্তরের সেই সদ্য তরুণ বিপ্লবীদের কাছে মৃত্যু ছিল এক পাহাড়ের মত – বলতেন সেই অগ্নি আন্দোলনের হোতা কমরেড চারু মজুমদার (Charu Majumdar)। ছবির প্রোটাগনিস্ট অমল সোম আত্মাহুতি দেওয়া তরুণদের একজন। অমল নেতার সেই বাক্যটি বিশ্বাস শুধু করেনি, আত্মস্থ করেছিল। কিন্তু পুলিশের নির্মম অত্যাচারের কাছে সে কি স্থির প্রতিজ্ঞ থাকতে পেরেছিল? না পারলে, বিশ/তিরিশ বছর বাদে রক্তিম নামে এক আপাত শান্ত নির্বিরোধী স্কুল শিক্ষকের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে নতুন তরুণ ড্রাকুলার মত দাঁত নিয়ে জন্মায় কেন? পুলিশ জেলখানায় অত্যাচারের সময় অমলের দু’টি দাঁত উপড়ে নেয়। আমরা দেখি রক্তিমের মুখে সেই দাঁত দুটিই একটু লম্বা আকারের। যে কারণে, স্কুলে তাঁর পরিচয় ‘ড্রাকুলা স্যার’। চিত্রনাট্যকার ও পরিচালকের চমকে দেওয়া মুন্সিয়ানা হল এই স্যারের মধ্যে অমল সোমের প্রতিশোধ ভাবনা ঢুকিয়ে দেওয়া।
হ্যাঁ, এখানে অনেকটাই তরলীকৃত হয় রাজনৈতিক বক্তব্য। রক্তিম তাঁর ড্রাকুলা দাঁত দিয়ে একের পর এক মানুষের ঘাড়ে কামড় বসিয়ে প্রতিশোধ নিতে থাকে। এসে যায় অমলের প্রেমিকা মঞ্জরী। তাঁর উপস্থিতি সবটাই কাল্পনিক, কিছুটা ভূতুড়েও বৈকি! দেবালয় গল্পের মধ্যে গল্প ঢুকিয়ে, তার শাখাপ্রশাখা ছড়িয়ে আম দর্শককে কিঞ্চিৎ গুলিয়েও দেন। এজন্ম ও অতীতজন্মের সীমারেখা খুবই সূক্ষ্ম। তাঁর চিত্রনাট্য বেশ সরু সুতোর ওপর দিয়ে সুন্দর ভারসাম্য রেখেই এগিয়েছে। বুদ্ধিমান দর্শক সেটা ধরতে পারলেই ছবির মজা, শ্লেষ, ব্যান্টারিংগুলো উপভোগ করতে পারবেন। সাতটি অধ্যায়ে ভাগ করার পরও উপসংহারের প্রয়োজন ছিল কি? যদিও আম জনতার কথা ভেবেই হয়তো এমন কাঠামো। তবে, ছবি আরও আগে শেষ হতেই পারত। অতীত ও বর্তমানের বারবার ওভারল্যাপ করার প্রয়োজন ছিল না। অধ্যায় ভেঙ্গে ভেঙ্গে ঘটনাগুলো দেখানোর ফলে একধরনের লিনিয়ার স্ট্রাকচার যেমন ছবিটাকে কিঞ্চিৎ সহজ করে, তেমনি শিল্পের নান্দনিক গুণপানায় কিছু ঘাটতিও তৈরি করে, বিশেষ করে বৌদ্ধিক দর্শকের অনুভূতিতে।
[আরও পড়ুন: পুজোর শুরুতেই সুখবর, ক্যানসারকে হার মানিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরলেন সঞ্জয় দত্ত]
দেবালয়ের (Debaloy Bhattacharya) সিনেমা শৈলীর ভাবনা এবং তার সঠিক প্রয়োগ ছবিকে উতরে দেয় এক সুষম বিন্যাসে। এখানেই এই ছবির দেবালয় তাঁর আগের নিজের দু’টি ছবির দেবালয় থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যান। এবং সেজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। নবারুণ ভট্টাচার্যের কবিতার লাইন তো বটেই, এ ছবির গান, সংলাপ নিশ্চিত ভাবেই বাংলা ছবির ঘরানার বাইরে, অনেক কাব্যিক, আবার খুবই তীব্র ও তীক্ষ্ণ। অধ্যায়গুলো নামকরণের মধ্যেও গভীর অর্থ রয়েছে। একটি গান “কষ্ট পাবে জানি…..” সত্যিই কষ্টের ঢেউ নয়, স্রোত তোলে।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য (Anirban Bhattacharya) হয়েছেন রক্তিম অর্থাৎ ‘ড্রাকুলা স্যার’। জেকিল ও হাইডের মত তাঁর দু’টো রূপ। একজন অতি শান্ত, অন্যজন ক্ষণে ক্ষণে রক্তপিশাচ। দু’টি রূপেই তিনি সমান সাবলীল। বিশেষ করে সাধারণ শান্ত চেহারায়। প্রেমিকা মঞ্জরীর সঙ্গে তাঁর আবেগপূর্ণ দৃশ্যগুলো সুন্দর। অমল ও রক্তিম দু’টি চরিত্রের ফারাকটুকুও অনির্বাণ ছোট্ট ছোট্টো কাজে বুঝিয়ে দিয়েছেন। মঞ্জরীর চরিত্রে মিমি চক্রবর্তী (Mimi Chakraborty) শুধু সঙ্গ দিয়েছেন, তাঁর করার মত কোনও দৃশ্য ছিল না। অল্প সুযোগে বিদিপ্ত চক্রবর্তী, রুদ্রনীল ঘোষ, সুপ্রিয় দত্ত তাঁদের সুনাম অনুযায়ী অভিনয় করেছেন। আর দেখার মত রয়েছে ইন্দ্রনাথ মারিকের ক্যামেরার কাজ। সব ছাপিয়ে যায় ছবির অন্তর্নিহিত বক্তব্য। যা আজকের বাংলা সিনেমায় প্রায় দেখাই যাইনা। তবুও বলি, এই ছবি পুজোর আনন্দবাজারের ছবি নয় মোটেই, এই ছবি অন্য সময়ের, অন্য অনুভূতির।