ইন্দ্রনীল শুক্লা: ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘মোস্ট হ্যাপেনিং’। এই শব্দবন্ধ এই মুহূর্তে বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে যদি কোনও অভিনেত্রী সম্পর্কে বলা যায়, তবে তিনি হলেন নটী বিনোদিনী। আগামী দিনে তিনটি ছবিতে দেখা যাবে বাংলা মঞ্চের (Bengali Theatre) এই কিংবদন্তিকে। তাঁর জীবনের উপর নির্মিত একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক তৈরির কাজও শেষ। বিনোদন জগতে সর্বত্র বিনোদিনীকে (Noti Binodini) নিয়ে আলোচনা। ফিরে তাকানো যাক।
১৮৬২ সালে পতিতা পল্লিতে জন্ম বিনোদিনী দাসীর। মাত্র ১২ বছর বয়সে বাংলা থিয়েটারের (Theatre) জগতে পা দেন বিনোদিনী। সেই সময় রঙ্গমঞ্চে মেয়েদের কাজ করবার চল ছিল না। ১২ বছর বয়স থেকে অভিনয় করতেন। মাত্র ১১ বছরের কেরিয়ারে বাংলা থিয়েটারের আত্মার উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন নটী বিনোদিনী। দাপিয়ে অভিনয় করার পর মঞ্চকে (Stage Performance) মাত্র ২৪ বছর বয়সে বিদায় জানান বিনোদিনী। আজীবন ধরে তিনি নানা বঞ্চনা, উপেক্ষা পেয়েছেন। ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘সীতা’, ‘প্রমীলা’, ‘দ্রৌপদী’, ‘রাধা’, ‘মতিবিবি’, ‘শ্রীচৈতন্য’ – এমন বহু চরিত্রকে মঞ্চে উপস্থাপন করেন তিনি। আত্মজীবনী ‘আমার কথা’- ও রেখে গিয়েছেন তিনি। নটী বিনোদিনী বিদায় নেন ১৯৪১ সালে।
মৃত্যুর আট দশক পরেও জনপ্রিয়তা এতখানি ভাঁটা পড়েনি! তাঁকে নিয়ে মুম্বইবাসী রামকমল মুখোপাধ্যায় তৈরি করছেন ‘বিনোদিনী- একটি নটীর উপাখ্যান’ যেখানে নটীর ভূমিকায় রুক্মিণী মৈত্র (Rukmini Moitra)। রানা সরকারের প্রযোজনায় তৈরি হচ্ছে ‘লহ গৌরাঙ্গের নাম রে’, যেখানে নটীরূপে দেখা যাবে প্রিয়াঙ্কা সরকারকে। হিন্দিতে ‘নটী বিনোদিনী’র বায়োপিক (Biopic) পরিচালনা করতে চলেছেন প্রদীপ সরকার, যেখানে কঙ্গনা রানাউত (Kangana Ranauat) হচ্ছেন নটী। আবার অবন্তী চক্রবর্তীর নাটক ‘বিনোদিনী অপেরায়’ নটীরূপে সুদীপ্তা চক্রবর্তী (Sudipta Chakraborty)।
কেন আজও এত উন্মাদনা নটীকে নিয়ে? রামকমল মনে করছেন, ‘যখন কোনও মানুষের জীবনে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত থাকে তখন তার জীবন নিয়ে মানুষের মধ্যে খুব উৎসাহ থাকে। আজও বিনোদিনীকে নিয়ে মানুষের যে অসীম কৌতূহল রয়েছে, সেটা অনস্বীকার্য। গ্রাম, শহর, শহরতলির নানা মানুষের সঙ্গে কথা বলে আমি দেখেছি সকলের মধ্যে কী ভীষণ ভালবাসা রয়েছে ওঁকে ঘিরে। নটী বিনোদিনী কোনও সাবজেক্ট নয়, উনি একটা ইমোশনের নাম।’
[আরও পড়ুন: বাইক রেখে দ্বিতীয় হুগলি সেতু থেকে ঝাঁপ, নিখোঁজ শিয়ালদহ আদালতের আইনজীবী]
রানা সরকার আবার নটী বিনোদিনীর সঙ্গে ঠাকুর রামকৃষ্ণদেবের (Sree Ramkrishna) দেখা হওয়ার ঘটনাকে আলাদা গুরুত্ব দিতে চাইছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বহু নটী বাংলায় ছিলেন যাঁরা অসম্ভব প্রতিভাবান। বিনোদিনী অসাধারণ অভিনেত্রী, মঞ্চ কাঁপিয়েছেন, গিরিশ ঘোষের শিষ্যা ছিলেন সব ঠিক। কিন্তু রামকৃষ্ণ দেবের সঙ্গে তাঁর দেখা হওয়ার ঘটনাটা তাঁকে একটা অন্য মাত্রায় নিয়ে চলে গিয়েছিল। বিনোদিনী অভিনীত চৈতন্যের উপর নাটক দেখতে এসে ঠাকুর বলেছিলেন তোমার চৈতন্য হোক। সে সময়ে নটীদের সমাজে নিচু নজরে দেখা হতো, তা সত্ত্বেও ঠাকুর এসে আশীর্বাদ করেছিলেন বিনোদিনীকে, এই ঐতিহাসিক ঘটনা মানুষের মনে গেঁথে রয়েছে।’’
[আরও পড়ুন: ফেসবুকে স্বেচ্ছামৃত্যুর পোস্ট গায়ক অনিন্দ্যর, ‘বন্ধু’কে সামলাতে কী করলেন ‘ক্যাকটাসে’র সিধু?]
থিয়েটার পরিচালক অবন্তী চক্রবর্তীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে তীব্র পিতৃতান্ত্রিক সামাজিক পরিবেশের মধ্যে নটীর উঠে আসা এবং সাফল্যলাভ। তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘‘নটী মারা যাওয়ার ৫০০ বছর পরেও যদি বাংলা থিয়েটার থাকে তাহলে উনিও প্রাসঙ্গিক থাকবেন। ওনার অভিনয়, কনট্রিবিউশন ছাড়াও বলা দরকার উনি যে পিতৃতান্ত্রিক পরিবেশের মধ্যে কাজ করেছিলেন, যে রকম সামাজিকভাবে ব্রাত্য থাকা অবস্থাতেও মঞ্চের কাজে সফল হয়েছিলেন সেটা তুলনাহীন। তাও মাত্র উনি ১১ বছর কাজ করেছেন।’’
তিনটি ফিল্মে নটীর আগমন সম্পর্কে আপ্লুত অবন্তী। তিনি বলছেন, ‘‘নাটকের মানুষ তো নটীকে নিয়ে সেলিব্রেট করবেনই। কিন্তু ফিল্মেও যে এমন ব্যাপারটা ঘটছে, এটা খুবই প্রশংসার। যেটা আমার একটু অবাক লাগছে সেটা হল সবাই একই সময়ে নটীকে নিয়ে কাজ করছেন। তবে সেটা অবশ্যই কো-ইনসিডেন্স।’’ প্রদীপ সরকার অবশ্য নটীকে নিয়ে হিন্দিতে ছবি করছেন। আশাবাদী রামকমল বলছেন, ‘‘প্রদীপদাকে পরিচালক হিসেবে এবং কঙ্গনাকে অভিনেত্রী হিসেবে আমি খুবই ভালবাসি। প্রদীপদা নিশ্চয়ই ওনার নিজস্ব স্টাইলে খুব সুন্দর কিছু বানাবেন।’’
নটীর খবরের শিরোনামে আসা এবং অভিনয়ের টেকনিক্যাল দিকগুলো প্রসঙ্গে রামকমল বলছেন, ‘‘ছবি তৈরির রিসার্চের কাজের সময়ে দেখেছি ভয়েস মডিউলেশন, মেক-আপ, স্টেজ প্রেজেন্সের মতো ক্ষেত্রে নানা চেঞ্জ এনেছেন নটী। উনি এশিয়ার (Asia) প্রথম অভিনেত্রী যাঁর ছবি বিদেশি ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল। আর উনি সম্ভবত না জেনেই মেথড অ্যাক্টিং শুরু করেছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভু করতে গিয়ে উনি হবিষ্যান্ন খাওয়া, ১০৮ বার দুর্গা নাম জপ করা, গঙ্গায় গিয়ে ডুব দেওয়া, নিজেকে পিওর ফর্মে নিয়ে আসার জন্য এসব করেছেন। শুধুমাত্র স্ক্রিপ্ট মুখস্থ না করে চরিত্রটার যাপন করা শুরু করেছিলেন উনি। পরবর্তীকালে আমরা যে বাংলায় দারুণ সব অভিনেত্রীদের পেয়েছি, তাতে নটীর অবদান অনেকখানি।’’ নটী বিনোদিনীকে নিয়ে ঘোর অতএব কেটে যাওয়া সম্ভব নয়। সেই যুগ নেই, সেই মঞ্চ নেই। কিন্তু তিনি আছেন। তাই হয়ত বারবার ফিরে ফিরে আসছেন মানুষের ভাবনায়, মননে কিংবা শ্রদ্ধায়।