রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: পাঁচ বছর আগে ইউরো (Euro 2020) ফাইনালের প্যারিস-রাতের পর কখনও আর বেঞ্জামিনের সঙ্গে দেখা হয়নি। জীবদ্দশায় সম্ভবত আর হবেও না। কিন্তু মন বলে বস্তুটা থাকবে যত দিন, স্মৃতির সঙ্গে যত দিন বন্ধুত্ব থাকবে, বেঞ্জামিনকে ভোলা অসম্ভব।
বেঞ্জামিন রাঘব বোয়াল কেউ নন। আপনার মতোই এক আম-সিআর (CR7) সমর্থক। এক পাগল সমর্থক। দিন দু’য়েক আগে বিলেতের এক কাগজে দেখলাম, পর্তুগালের শেষ ইউরো জয় নিয়ে প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পেপে বলেছেন, কীভাবে সমগ্র টিম তেড়েফুঁড়ে উঠেছিল প্রাণাধিক প্রিয় সিআরকে ট্রফিটা দিতে, জীবন বাজি রেখে। সাঁ দেনির সেই অমর রাতের রোমাঞ্চ-কাহিনি লিখেছিলেন যিনি, সেই এডের দেখা গেল বলেছেন কী ভাবে রোনাল্ডো তাঁকে বিশ্বাস-এনার্জি-ভরসা জুগিয়েছিলেন। বুঝিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষেই সম্ভব ইতিহাস সৃষ্টির, সম্ভব ফাইনালে গোল করে দেশকে ইউরো (Euro Cup) জয়ীর তাজ পরিয়ে দেওয়া।
[আরও পড়ুন: করোনা আতঙ্ক কাটিয়ে শুরু Euro Cup 2020, প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত জয় ইটালির]
লেখাটা পড়তে পড়তে মনে হল, নতুন করে সৃষ্ট সেই উৎসব-আমেজে অনায়াসে বেঞ্জামিনকে ঢুকিয়ে নেওয়া যেত। এক-আধ জন নয়, শত শত বেঞ্জামিনকে। যাঁদের সেই প্যারিস রাতের আইফেল টাওয়ার ফ্যান জোনে দেখেছিলাম ইউরো কভার করতে গিয়ে। যাঁরা সে দিন বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন দু’বার। প্রথম বার, পায়েতের ট্যাকলে রোনাল্ডো মাঠ ছেড়ে বেরনোর সময়। যখন তাঁরা আছড়ে পড়েছিলেন সন্তান হারানোর শোক নিয়ে। দ্বিতীয় বার ‘হুইসল’ বাজার পর। যখন তাঁদের গাল বেয়ে নামছিল অশ্রুর আনন্দ-ঝর্ণাধারা। আর এ হেন বেঞ্জামিনরা পৃথিবীর সমস্ত দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকেন। যাঁরা নাম-ধর্ম-বর্ণ-গোত্রে শুধু আলাদা। কিন্তু বিগ্রহ সবার এক। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo)!
এবং খোঁজ না নিয়েও নিশ্চিন্তে লিখে ফেলা যায়, এ হেন শত শত বেঞ্জামিনরা আবারও তৈরি হচ্ছেন। তৈরি হচ্ছেন, আরও এক সিআর-উৎসবে গা ভাসিয়ে দিতে। আগামী মঙ্গলবার থেকে। যে দিন হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে অবতরণ ঘটবে ফুটবল-দেবদূতের। এঁরা কেউ সশরীর মাঠে যাবেন। কেউ টিভির সামনে বসবেন। শুধু একটা বিশ্বাসকে সঙ্গী করে। পর্তুগাল (Portugal) দেশটার কিছু নেই। পর্তুগালে চাকরি নেই। মর্যাদা নেই। জীবন নেই। পর্তুগালের শুধু একটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো আছে। আর সে যত দিন আছে, ট্রফি জয়ের মায়াময় রাতও জীবনে আছে।
[আরও পড়ুন: ইতিহাসের হাতছানি, ইউরোতে রোনাল্ডোর সামনে ৫টি রেকর্ড ভাঙার সুযোগ]
গত ইউরোর চেয়ে বর্তমান পর্তুগাল টিমটায় নক্ষত্র কত! ব্রুনো ফার্নান্ডেজ, জোয়াও ফেলিক্স, বার্নার্ডো সিলভা। ফুটবল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্তুগালে এবার গোল করার লোক প্রচুর। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো একাই শো-স্টপার হবেন না। হায় রে, বিজ্ঞকুল! এঁদের কে বোঝাবে, সমর্থকদের হৃদয়ে পর্তুগাল দেশটার সমনামী একজনই, রোনাল্ডো। বাকিরা বড়জোর পার্শ্বনায়ক হতে পারেন। মহানায়ক কিছুতেই নন। বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করুন বেঞ্জামিনদের।
তা ছাড়া বেশ কিছু জবাব দেওয়াও বাকি। ছত্রিশের রোনাল্ডো নাকি আগের মতো ভয়ংকর নন, বলছে লোকে। রোনাল্ডো জুভেন্তাসকে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ দিতে পারেননি, শোনাচ্ছে লোকে। কোনও কোনও ফুটবল বিশেষজ্ঞ আবার বলেছেন, পর্তুগাল গত ইউরো পেয়েছে স্রেফ কপালজোরে। ঠোঁটগুলোকে চিরতরে সেলাই করে দেওয়া খুব প্রয়োজন, আগামী মঙ্গলবার থেকে দেখানো প্রয়োজন সূর্যাস্তের লগ্নেও নতুন সূর্যোদয় সম্ভব, ছত্রিশেও সম্ভব অবিশ্বাস্য। পাঁচ-পাঁচটা রেকর্ডের শৃঙ্গ অপেক্ষা করে আছে, যার আরোহণ অতীব প্রয়োজন।
ইউরোয় সবচেয়ে বেশিবার আবির্ভাবের রেকর্ড। সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ড। ইউরোয় গোল বিচারে এখন প্লাতিনি-রোনাল্ডো সমান সমান। দু’জনেরই নয়। রোনাল্ডো একটা গোল করলেই প্লাতিনি ইতিহাস হয়ে যাবেন। কোয়ালিফাইং রাউন্ড ধরে ইউরোর ম্যাচ খেলার রেকর্ডও হাতছানি দিচ্ছে সিআরকে। জিয়ানলুইগি বুফোঁ সবচেয়ে বেশি, ৫৮ ম্যাচ। রোনাল্ডো ৫৬। দাঁড়ান, আরও আছে। রোনাল্ডো এবারও ইউরো জিতলে তিনিই হবেন প্রথম অধিনায়ক, যাঁর ক্যাবিনেটে দু-দু’টো ইউরো থাকবে। ফাইনালে গোল করলে তিনিই হবেন ইউরো ইতিহাসের সর্বজেষ্ঠ্য প্লেয়ার, যাঁর ফাইনালে গোল থাকবে। আরও একটা জিনিস করা দরকার। দেশের জার্সিতে একাধিক থাকলেও ইউরোয় কোনও হ্যাটট্রিক নেই রোনাল্ডোর। ওটা চাই। ছেড়ে দেবেন সিআর এ সব? চাইবেন না ইউরো ছেড়ে শেষ বারের মতো যাওয়ার আগে সব রাঙিয়ে দিতে?
[আরও পড়ুন: Euro Cup 2020: সোনালি প্রজন্মের পর তারুণ্যেই ভরসা স্পেনের, দেখুন টিম প্রোফাইল]
প্রয়োজনীয় ‘পাঞ্চজন্য’ কিন্তু ইতিমধ্যে ফুঁকে দিয়েছেন পর্তুগিজ মহাতারকা। দেশের ফুটবল ফেডারেশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলে দিয়েছেন, জীবনের প্রথম ইউরোর মতো মোটিভেশন পাচ্ছেন। টুর্নামেন্টের কথা ভাবলেই গা গরম হয়ে যাচ্ছে! বলেও দিয়েছেন, “আমার টিম তৈরি। সেই একই খিদে, একই উচ্চাশা দেখবেন আপনারা।” সঙ্গে প্রতিপক্ষদের উদ্দেশ্যে হাড় হিম করা বার্তা, পর্তুগাল ক্যাপ্টেনও কিন্তু তৈরি! পর্তুগাল ডিফেন্সের স্তম্ভ জোস ফন্টেও বিপক্ষ-উপকূলে আগাম সতর্কবার্তা জারি করেছেন। বলে দিয়েছেন, রোনাল্ডো এখনও পারেন সব তছনছ করে দিতে। রোনাল্ডো এখনও ‘দ্য বিস্ট।’ তা, জাগুন না ‘দ্য বিস্ট।’ অতিমারী আক্রান্ত এ নশ্বর জীবনে পড়ে আছেটা কী? চলুক না ইউরো জুড়ে গর্বিত গ্রীবার দাপাদাপি, করোনার অন্ধকার আকাশ ফুঁড়ে আশার বিদ্যুৎ হয়ে থাকুক না ওই এক-একটা আকাশছোঁয়া লাফ। প্রত্যাশা, দাবিদাওয়া হারানো মানুষ তবু তো কিছু নিয়ে বাঁচবে একটা মাস। বাঁচবে একটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিয়ে!