বিশ্বদীপ দে: কয়েকদিন আগের কথা। সিনেমা হলে হইহই করে এসে পড়েছে স্পাইডারম্যানের নয়া অ্যাডভেঞ্চার। বহুদিন পরে হলের বাইরে লাইন।মাকড়শা মানুষকে দেখতে সকলে ভিড় জমাচ্ছে। আমার এক বন্ধুর সঙ্গে ছবিটা নিয়ে কথা হচ্ছিল। কিন্তু কথাটা আচমকাই বাঙালির কমিকস-হিরোর দিকে বাঁক নিল। সঙ্গে সঙ্গে সেই বন্ধুর দীর্ঘশ্বাস, ‘‘ইস! বাঁটুল, নন্টে-ফন্টে, হাঁদা-ভোঁদাদের নিয়েও এমন এক ইউনিভার্স যদি তৈরি করা যেত!’’ মঙ্গলবাসরীয় সকালে যখন নারায়ণ দেবনাথের (Narayan Debnath)মৃত্যুসংবাদ এসে পৌঁছল, আচমকাই সেই বন্ধুর কথাটা মনে পড়ল। সোশ্যাল মিডিয়ার দেওয়াল ক্রমে ভরে উঠছে স্মৃতিচারণায়। সেটাই স্বাভাবিক। নারায়ণ দেবনাথ এক এমন জাদুকরের নাম, যাঁর নামটুকু উচ্চারণই যথেষ্ট। সির্ফ নাম হি কাফি হ্যায়। তাঁর চরিত্রদের নিয়ে ঝাঁ চকচকে অ্যানিমেশন হয়তো হয়নি। কিন্তু তাঁর কলম-তুলির স্পর্শে প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে হরেক রঙের আতসবাজির যে অনর্গল ঝলমলানি, তা কি কম নাকি? কম তো নয়ই। বরং অনেক অনেক বেশি। গোটা শৈশব উপচে পড়েও উদ্বৃত্ত থেকে যায়।
বাঙালি এখন গ্লোবাল। তার রুচিরও বিস্তর বদল ঘটেছে। কিন্তু আজও বইমেলায় বাঁটুল, হাঁদা-ভোঁদা কিংবা নন্টে আর ফন্টে, কেল্টুদাদের ঘিরে ছোট ছোট হাসিমুখের ভিড় নজর এড়ায় না। অথচ সেই অর্থে খুব বড় কোনও পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে কিন্তু চরিত্রগুলো যায়নি। তারা মোবাইল ব্যবহার করেনি। শপিং মল কিংবা অনলাইনের চক্করেও নেই। যেন অন্য সমস্ত পরিবর্তনের সঙ্গে কিছুটা বেমানানই। তবু… ওই তবুতেই আসল মজা। বহিরঙ্গে যতই বদলাক, শৈশব আসলে শৈশবই। তাই সেদিন যারা চিলেকোঠায় বসে শীতের দুপুরে বাঁটুল পড়ত তাদের নাতিপুতিরা ফ্ল্যাটবাড়ির একচিলতে বারান্দায় বসেও নারায়ণ দেবনাথের চরিত্রদের সঙ্গে সময় কাটায়। আর সেটা কাটায় ওদের সঙ্গে রিলেট করতে পারছে বলেই। এ এক বিরাট সাফল্য। নারায়ণ দেবনাথ এমন এক বাদ্যযন্ত্রের তারে টান দিয়েছিলেন, যার সুর প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে একই রকম বেজে গিয়েছে। বেজে চলেছে আজও।
[আরও পড়ুন: বাঙালি জীবনের রূপকার, গোমড়া হতে দেননি শৈশবকে, নারায়ণ দেবনাথ এক আশ্চর্য ম্যাজিশিয়ান]
১৯৬২ সালে ‘হাঁদা-ভোঁদা’, তিন বছর পরে ‘বাঁটুল দি গ্রেট’ আর ১৯৬৯-এ ‘নন্টে-ফন্টে’। সে বড় সুখের সময় নয়। সদ্য স্বাধীন দেশে তখনও যুদ্ধের ধিকি ধিকি আগুন কিংবা রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তেজনা ছড়িয়ে রয়েছে। বড়দের দুনিয়ার সেই সব অনিশ্চয়তার প্রভাব কি ছোটদের মধ্যেও পড়ত না? পড়ত। তবু সেই সব জটিল কুটিল পরিস্থিতি থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে যেত হাঁদা-ভোঁদাদের নিরলস আনন্দ-মজা। সেই সময়কার মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত বাঙালির টানাটানির সংসারের ফাঁকফোকর ভরিয়ে রাখতেন যাঁরা তাঁদের অন্যতম নারায়ণ দেবনাথ তাই নিজেই যেন হয়ে উঠেছিলেন এক সুপারহিরো। যাঁর সুপার পাওয়ার হাতে ধরা রং-তুলির জাদুস্পর্শ।
বাঙালি তখন খবরের কাগজে একফালি ফ্যান্টম পেত রোজ। চলমান অশরীরীকেও আপন করে নিয়েছিল সে। কিন্তু সেই সঙ্গেই নারায়ণ দেবনাথের হাত ধরে নিখাদ বাংলা কমিকসেও এক স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল। ময়ূখ চৌধুরীর মতো শিল্পীরাও ছিলেন। ছিলেন অন্যরাও। তাঁদের সকলের চেষ্টায় দ্রুত বাংলা কমিকসের একটা চরিত্র তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারপর সময় বদলেছে। হরেক কার্টুন, অ্যানিমেশনের ভিড়ে আজকের প্রজন্ম যেন অনেকটাই বইবিমুখ। বিশেষ করে বাংলা বই। কিন্তু তবুও তারা নারায়ণ দেবনাথকে ছাড়তে পারেনি। ছাড়লে আজও একই ভাবে বইগুলি বিক্রি হয়ে চলত না।
নারায়ণ দেবনাথ আরও কয়েকটি কমিকস স্ট্রিপের স্রষ্টা। সারা জীবন ধরেই করে গিয়েছেন অসামান্য ইলাসট্রেশন। সমস্ত কিছুর মধ্যেই এমন এক মৌলিকত্ব ছিল যা তৈরি করে দিয়েছিল দুরন্ত সিগনেচার। একটা সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। ভেবে দেখুন নারায়ণ দেবনাথ ব্যবহৃত অনুকার অব্যয়গুলি— ঢকাস, খ্যাড়াং, ছলাস, ইরক, উলস জাতীয় শব্দের মধ্যেই যেন বুনে দেওয়া আছে নিখাদ বাঙালিয়ানা। ঠিক যেমন ‘থাউজ্যান্ডস অফ থান্ডারিং টাইফুনস’ বললেই মনে পড়ে যায় ক্যাপ্টেন হ্যাডককে, তেমনই এই সব শব্দবন্ধই যথেষ্ট এটা কার লেখা তা বুঝিয়ে দিতে।
[আরও পড়ুন: নিয়মিত করতেন শরীরচর্চা, সাজতেন টারজান, এমনই ছিল নারায়ণ দেবনাথের ছোটবেলা]
অবশ্য কেবল ছোটরাই কি তাঁকে পড়ে? নাহ! পড়ে বড়রাও। তাদের কাছে বাঁটুল কিংবা হাঁদা-ভোঁদার কমিকস আসলে এক অনন্য নেভারল্যান্ডে পালিয়ে যাওয়ার ছাড়পত্র। ইএমআই বাকি পড়া বাঙালি, সম্পত্তি বিবাদে আপনজনদের কাছ থেকে আঘাত পাওয়া বাঙালি আজও সব তিক্ততা ভুলতে যাঁদের কাছে আশ্রয় নেয়, সে সুকুমার রায় হোন কিংবা লীলা মজুমদার— সেই তালিকায় নারায়ণ দেবনাথও রয়েছেন। থেকে যাবেন আরও বহু বহু বছর। মৃত্যু অনতিক্রম্যই। দীর্ঘায়ু নারায়ণ দেবনাথের মৃত্যুকে তাই আমাদের মেনে নিতেই হবে। সেই সঙ্গে এও মানতে হবে, আমাদের শৈশবের যে অংশটা তাঁর কাছে বাঁধা পড়ে আছে তা থেকে যাবে একই রকম। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের মতোই।