shono
Advertisement

Breaking News

Tintin

বর্ণবিদ্বেষী টিনটিনের ঘোর অপছন্দ ছিল বামপন্থীদের! অ্যার্জের অমর সৃষ্টিকে ঘিরে বিতর্কও কম নয়

বিতর্কের সূত্রপাত টিনটিনের প্রথম কমিক্স থেকেই।
Published By: Biswadip DeyPosted: 09:35 PM Jan 03, 2025Updated: 09:39 PM Jan 03, 2025

বিশ্বদীপ দে: হাওড়া সেতু দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এক মোরগঝুঁটি চুলের তরুণ। সঙ্গে একটা ছোট্ট সাদা কুকুর! পাশেই হাঁটছে দাড়িওয়ালা এক রাগী রাগী মানুষ। সঙ্গে কি এক আপনভোলা বিজ্ঞানীও? আর যমজ অপদার্থ গোয়েন্দা? তারাও বুঝি রয়েছে সেই দলে। নাহ! এই দৃশ্য কেবল স্বপ্নেই দেখা যায়। কেননা স্রষ্টা অ্যার্জে প্রয়াত হয়েছেন চার দশক হল। ফলে টিনটিন তার দলবল নিয়ে এই শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন দৃশ্য কোনও কমিক্সের পাতায় 'জ্যান্ত' হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তিব্বতে বন্ধু চ্যাংকে খুঁজতে গিয়ে সে দিল্লি ছুঁয়ে গিয়েছিল। এর বাইরে এদেশের কিছুই দেখা হয়নি বেলজিয়ামের সাংবাদিকের। কিন্তু বাঙালির সঙ্গে তবু তার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর দুরন্ত অনুবাদে যে হয়ে উঠেছে 'ঘরের ছেলে'। কিন্তু কিশোরপাঠ্য টিনটিনকে নিয়ে বিতর্কও কম নেই। বর্ণবিদ্বেষ, বন্যপ্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা থেকে অ্যান্টি-কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার মতো নানা অভিযোগে বিদ্ধ টিনটিন থুড়ি অ্যার্জে। যদিও পরে সেসব কাটিয়ে উঠেছিল এই কমিক্স। তবু বিতর্কের কালো ছায়া তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।

Advertisement

আর এই বিতর্কের সূত্রপাত টিনটিনের প্রথম কমিক্স থেকেই। 'টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য সোভিয়েতস'। ১৯২৯ সালের সেই কমিক্সে টিনটিন গিয়েছিল সোভিয়েত দেশে। সেখানে দেখানো হয়েছিল, কমিউনিস্টরা বন্দুকের জোরে ভোটে জেতে! সেখানকার কারখানার ধোঁয়ার মূলে নাকি খড়কুটো! কমিউনিস্ট বিরোধী প্রোপাগান্ডার একেবারে ছড়াছড়ি।

বলসেভিকরা সেখানে একেবারে 'ভিলেন'! কিন্তু কেন? কেন বামপন্থীদের উপরে এমন হাড়ে চটা ছিলেন রেমি জর্জ ওরফে অ্যার্জে? আসলে বেলজিয়ান সংবাদপত্র ‘পেতি ভ্যাতিয়েম’-এর পৃষ্ঠপোষক নর্বার্ট ওয়ালেস ছিলেন দক্ষিণপন্থী। এদিকে ১৯১৯ সালে বেলজিয়ামের নির্বাচনে দেখা গিয়েছিল ক্যাথলিক পার্টির মতো দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছিল বেলজিয়াম লেবার পার্টি। এই দলটি মোটামুটি বামপন্থী দল। প্রাপ্ত আসন ছিল সমান সমান। ফলে সরকার গড়তে তাদের হাত ধরতেই হয়েছিল দক্ষিণপন্থীদের। আর তারাও সেই সুযোগে 'দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি শ্রম করানো যাবে না'র মতো আইন পাশ করিয়ে নিয়েছিল। সুতরাং দেশের ভাবী প্রজন্মকে বামপন্থী ছোঁয়াচ থেকে দূরে রাখতেই টিনটিনের কমিক্সে এমন সব ব্যাপার স্যাপার ঘটিয়েছিলেন অ্যার্জ। 'মস্কো আনভেইলড' নামের একটি বইয়ের উপরে নির্ভর করেছিলেন তিনি। সেখানে বর্ণিত নানা অতিরঞ্জিত ব্যাপার স্যাপার টিনটিনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন।

এখানেই শেষ নয়। টিনটিনের দ্বিতীয় অভিযান 'টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো'। সেখানে আবার বর্ণবিদ্বেষের তীব্র কটু গন্ধ। আফ্রিকার ওই দেশ সম্পর্কে রীতিমতো সাম্রাজ্যবাদী ও শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের জলছাপ এই কমিক্সের পাতায় পাতায়। ২০০৭ সালে কঙ্গোলিজ ছাত্র বিয়েনভেনু বুটু মন্দোন্দো ১৯৩১ সালে প্রকাশিত বইটির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। তাঁর অভিযোগ, এখানে আফ্রিকানদের যেভাবে দেখানো হয়েছে তা একেবারেই বিদ্বেষপূর্ণ... রেসিস্ট। যদিও আদালত জানিয়ে দেয়, এই বইকে বিদ্বেষপূর্ণ বলা যায় না। এরপরও কিন্তু বিতর্ক থামেনি।

আসলে বিংশ শতাব্দী ও একবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় অনেক বিশেষজ্ঞই দাবি করেছেন, এখানে কঙ্গোর অধিবাসীদের বোকা ও শিশুসুলভ দেখানো হয়েছে। বলা হয়েছে, এদের এমনভাবে দেখানো হয়েছে যেন এরা মনের দিক দিয়ে ভালো। কিন্তু আদতে অলস। ইউরোপীয় প্রভুরাই এদের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে। যদিও এমন বিতর্ক বইটি প্রথম প্রকাশের সময় হয়নি। কিন্তু গত শতকের পাঁচ ও ছয়ের দশকে আফ্রিকা ঔপনিবেশিক প্রভুদের হাত থেকে মুক্ত হতে শুরু করার পর শুরু হয় আলোচনা। আফ্রিকার ভূমিপুত্র তথা কাফ্রিদের প্রতি পশ্চিমি দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য সেই সময় তেমনই ছিল। হ্যারি থম্পসনের মতে, 'টিনটিন ইন কঙ্গো'কে তিরিশ-চল্লিশের ইউরোপীয় সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে দেখাটা দরকার। তাঁর মতে, সাধারণ বেলজিয়ানদের তৎকালীন দৃষ্টিভঙ্গিটাই ছিল এমন। অ্যার্জেও ছিলেন তেমনই। তখন কঙ্গো ছিল বেলজিয়ান কঙ্গো। হ্যাঁ, কঙ্গো সেই সময় ছিল বেলজিয়ামের উপনিবেশ। আর সাহেবসুবোদের দৃষ্টিভঙ্গি 'নেটিভ'দের প্রতি কেমন ছিল তা সকলেরই জানা। যাদের সম্পদ আত্মসাৎ করে পকেট ভারী হচ্ছে, তাদের প্রতিই একটা 'দুচ্ছাই' ভাব সেযুগে একেবারে স্বাভাবিক ছিল। অ্যার্জে সেই প্রভাব থেকে বেরতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ''কঙ্গো কিংবা সোভিয়েত দেশে টিনটিনের ক্ষেত্রেও এটাই সত্যি যে, আমি যে বুর্জোয়া সমাজের অংশ ছিলাম সেই সমাজের কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।... ১৯৩০ সালে আমি এই সব দেশ সম্পর্কে খুব কমই জানতাম। লোকেরা বলত, আফ্রিকানরা বিরাট শিশুদের মতো। ভাগ্যিস আমরা সেখানে গিয়েছিলাম... এই সব। আর আমিও এসব কথা মাথায় রেখেই তাদের এঁকেছিলাম। একেবারে পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতায় ভুগে, সেই সময় বেলজিয়ামে এটাই ছিল।''

বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। বন্যপ্রাণীদের উপর অত্যাচারও রয়েছে কঙ্গো অভিযানের পাতায় পাতায়। টিনটিন অ্যান্টিলোপকে গুলি করছে, একটা বাঁদরকে মেরে তার চামড়া পরছে, কুমিরের মুখের ভিতরে আড়াআড়ি ভাবে রেখে দিচ্ছে বন্দুক, হাতি মারছে, মোষকে পাথর ছুড়ছে- এমনই সব দৃশ্য! পরবর্তী সময়ে খোদ অ্যার্জে এর জন্য রীতিমতো আফসোসও করেছেন। আর নিজেকে বদলেছেন একটু একটু করে। তিব্বতে বন্ধু চ্যাংকে বাঁচাতে প্রাণপাত করেছিল টিনটিন। এমন বন্ধুবৎসল এক চরিত্রে তাকে রূপান্তরিত করতে পারাই শেষপর্যন্ত অ্যার্জের সাফল্য। হ্যাডক আসার পরে কমিক্সে মজার রস বাড়তে থাকে। আবার ইয়েতির মতো প্রাণীকেও যেভাবে দেখানো হয়েছিল তা বুঝিয়ে দেয়, অ্যার্জে বন্যপ্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতার মতো অভিযোগ থেকে দূরে সরে এসেছেন।

এখানে আরেকটা কথাও বলা যায়। বামপন্থীদের বিরোধিতা করার পাশাপাশি মার্কিন শ্বেতাঙ্গদেরও কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি অ্যার্জে। 'টিনটিন ইন আমেরিকা' ছিল সিরিজের তৃতীয় কাহিনি। সেদেশের সরকার ও বড় বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি মিলে 'নেটিভ' আমেরিকানদের সম্পদ আত্মসাৎ করা, তেলের খনির দখল নেওয়ার মতো নানা বিষয় তুলে ধরে পুঁজিবাদী মার্কিনদের তোপ দাগেন অ্যার্জে।

আরও একটা ব্যাপার। বামপন্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করা টিনটিন পরবর্তী সময়ে গিয়ে পড়েছিলেন 'বিপ্লবীদের দঙ্গলে'। সেই কমিক্সটির ইংরেজিতে নাম ছিল 'টিনটিন অ্যান্ড দ্য পিকারোস'। ১৯৭৬ সালের ওই কমিক্সে টিনটিন, কুট্টুস, হ্যাডক, প্রফেসর ক্যালকুলাস পাড়ি দিয়েছিল দক্ষিণ আমেরিকায়। সেখানে জেনারেল টাপিওকার সরকারের হাতে বন্দি বিখ্যাত গায়িকা বিয়াঙ্কা ক্যাস্টাফিওর। তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে টিনটিন জড়িয়ে পড়ে সরকার-বিরোধী বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে। তার সঙ্গী ছিল জেনারেল আলকাজার। যদিও এই টিনটিন-কাহিনিকে নানারকম সমালোচনা সইতে হয়েছিল। সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল দুর্বল কাহিনি কাঠামোর।

কিন্তু সে যাই হোক, টিনটিন কিন্তু এই সব কাহিনিতে বিপ্লবের কথা বলে নিজের আদ্যিকালের ভাবমূর্তিতে লাগা কালো রং অনেকটাই মুছে ফেলতে পেরেছিল। তবে বঙ্গানুবাদে নীরেন্দ্রনাথের সাবধানি প্রয়াস ছোটদের গায়ে এই সব বিতর্কের আঁচ লাগতে দেয়নি। ছোটবেলার রোদ্দুর-জল-হাওয়ার মতোই নির্মল আনন্দের ছোঁয়ায় টিনটিন এক স্বচ্ছ ও সৎ চরিত্র হয়েই থেকেছে আগাগোড়া। কুট্টুস, হ্যাডকদের সঙ্গে তার অভিযান তাই আজও একই রকম জনপ্রিয়। ২০২৫ সাল থেকে মার্কিন কপিরাইট আইন থেকে মুক্তি পেয়েছে টিনটিনের অ্যাডভেঞ্চার। ফলে পরবর্তী সময়ে আরও বেশি মানুষের কাছে টিনটিন পৌঁছবে, একথা হলফ করে বলাই যায়। তবে অ্যার্জে ও তাঁর সৃষ্টিকে ঘিরে থাকা বিতর্ক যে একেবারে শূন্যে মিলিয়ে যাবে না তা বলাই যায়। 'চাঁদের কলঙ্ক' হয়ে সেটাও থেকে যাবে মোরগঝুঁটি চুলের নিষ্পাপ বালকসুলভ চেহারা টিনটিনের।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • কিশোরপাঠ্য টিনটিনকে নিয়ে বিতর্কও কম নেই।
  • বর্ণবিদ্বেষ, বন্যপ্রাণীর প্রতি নিষ্ঠুরতা থেকে অ্যান্টি-কমিউনিস্ট হয়ে ওঠার মতো নানা অভিযোগে বিদ্ধ টিনটিন থুড়ি অ্যার্জে।
  • যদিও পরে সেসব কাটিয়ে উঠেছিল এই কমিক্স। তবু বিতর্কের কালো ছায়া তাকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।
Advertisement