আমি যে ধরনের ছবি বানাই নির্ভীক শিল্পী আমার খুব দরকার। ‘ভূতপরী’ মুক্তির আগে একান্ত আলাপচারিতায় বললেন সৌকর্য ঘোষাল (Soukarya Ghosal)। পরিচালকের মুখোমুখি শম্পালী মৌলিক।
২০১৪ সালে আপনার প্রথম ছবি ‘পেন্ডুলাম’ মুক্তি পেয়েছিল, এখন ২০২৪ সাল। ঠিক দশবছর কেটে গেল ইন্ডাস্ট্রিতে। কীভাবে পিছনে ফিরে তাকান?
‘পেন্ডুলাম’-এর পরে ‘লোডশেডিং’ বলে একটা ছবি করেছিলাম টেলিভিশনের জন্য। তারপরে আবার ২০১৮-এ ‘রেনবো জেলি’ করি, সেটা প্রায় তিন বছরের ব্যবধানে, সেইটা বড় সময় ছিল। কারণ, ‘রেনবো জেলি’-র বানানোর প্রক্রিয়া কঠিন ছিল। তারপরে ২০১৯-এ ‘রক্ত রহস্য’ শুট করি, ২০২০-তে মুক্তি পায়। তারপর লকডাউন এসে যায়, সমস্ত হিসাব ওলটপালট হয়ে যায়। যাই হোক, এরপরে ‘ভূতপরী’ শুট করি। ‘ওসিডি’, ‘কালান্তর’ করি তার পরে। কিন্তু রিলিজগুলো ঘেঁটে গিয়েছিল। সেটা মূলত লকডাউনের জন্য। আমার যেটা মনে হয়েছে দশ বছরে, ছবি বানানো থেকে মুক্তি পর্যন্ত, অনেকটা ডেস্টিনির ওপর নির্ভর করে। আমি প্রথমে মানতাম না। মনে করতাম, সবটাই করে ফেলা যায়। কারণ, দর্শক কীভাবে নেবে, সেটাও ফ্যাক্টর। এখন মনে হয়, একটা ছবির হয়তো সঠিক সময় হয়।
বেশ কমবয়সে আপনি ছবি পরিচালনায় এসেছিলেন, এই বিগত দশ বছর ইন্ডাস্ট্রি থেকে কী পেলেন মনে হয়? এই অভিজ্ঞতা কী শেখাল?
পজিটিভ দিক যদি বলি, সেন্স অফ রেসপনসিবিলিটির জায়গাটা বুঝেছি। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা ছবি যখন দারুণ চলে, তখন সবাই সমাদৃত হয়। কিন্তু একটা ছবি যখন চলে না, তখন পরিচালকের ছবিটাই চলে না ধরা হয়। তখন কিন্তু দোষটা ভাগ হয় না। এইটা আমি শিখেছি। সুতরাং দোষটা গ্রহণ করতে হবে। অনুরাগের একটা খুব ভালো কথা আছে– আ গুড ডিরেক্টর ইজ আ গুড ডিরেক্টর হু ক্যান পাস অন অল দ্য ক্রেডিটস অ্যান্ড টেক অন অল দ্য ব্লেমস। কোনওদিন শুনবেন না, একটা ছবি ফ্লপ করেছে, কারণ ওইখানে হেয়ারটা ভালো ছিল না। কিন্তু একটা ছবি হিট করার পর বলা হয়, কী ভালো দেখতে লাগছিল। হুইচ ইজ ট্রু। সুতরাং এটা মেনে নিতে হবে, আমরা যখন সফল হব, সাফল্য নিশ্চয়ই সকলের। কিন্তু যখন ব্যর্থ হব, ডিসক্রেডিট শুধুমাত্র পরিচালকের। এটা শিখেছি।
আর?
সারল্য যাতে চলে না যায়, সেই চেষ্টা করছি। ইনোসেন্সটা আগে অনেক বেশি নেকেড করে রাখতাম, এখন চেষ্টা করি সেটা কিছুটা ঢেকে রাখার। যাতে বোকা মনে না হয়।
[আরও পড়ুন: শুটিং শুরুর আগেই বদলে গেল সীতা! রণবীরের ‘রামায়ণ’-এ কে হবেন জানকী? ]
একদম শুরুতে একমাত্র ভালো ছবি বানানোই লক্ষ্য ছিল, নিশ্চিতভাবে বলা যায়। এখন কি মনে হয়, বক্স অফিসটাও গুরুত্বপূর্ণ?
আমি প্রথম থেকেই এই ছবিগুলো বানাতে চেয়েছি। যখন ‘পেন্ডুলাম’ বানিয়েছিলাম, তখন ছবিটা ‘কান’-এ পাঠিয়েছিলাম। ‘কান’ থেকে যে চিঠিটা পাঠিয়েছিল, এখনও মনে আছে। আমার চোখ খুলে গিয়েছিল। লেখা ছিল– তোমার ছবি আমরা কেন নেব? তোমার ছবিতে পাঁচটা গান আছে। ইটস আ পপুলার ফিল্ম। আমরা আর্ট ফর আর্ট’স সেক করি। যে ছবি আর্ট ফর আর্ট’স সেক, সেগুলোই করব। তখন আমি ভাবলাম, আমি কি গান-টান ছাড়া ছবি বানাতে পারব? আমার যেটা ভালো লাগে, সেটাই বানাতে চাই। একইসঙ্গে এটাও চাই, সেটা যেন অনেকের ভালো লাগে। আমি ‘দঙ্গল’, ‘পিকে’-র মতো ছবি বানাতে চাই। কিংবা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সোনার কেল্লার’ মতো ছবি বানানোর স্বপ্ন দেখি।
অবশেষে আপনার ‘ভূতপরী’ রিলিজ করছে ৯ ফেব্রুয়ারি। প্রায় চারবছরের অপেক্ষা তৈরি হয়ে যাওয়া পর। এই ডিলে কি একটু হতাশ করেছিল?
হ্যাঁ, একটা পর্যায়ে তো হতাশ হয়েছিলাম। কোভিড-লকডাউন ইত্যাদি মিলিয়ে। আর ‘ভূতপরী’ (Bhootpori) আমরা প্রচণ্ড যত্ন নিয়ে করার চেষ্টা করেছিলাম। মনে হয়েছিল, দর্শকের দেখলে ভালো লাগবে। আর ছবিটা সঙ্গে সঙ্গে বেরলে মনে হয়, ও আচ্ছা, এত তাড়াতাড়ি ডেভলপ করছে এই পরিচালকের ভিশন। এইটা ‘রক্তরহস্য’-র পরেই বেরলে সেটা মনে হত। এখন হয়তো অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে। কিন্তু ওটা শিখেছি ইন্ডাস্ট্রি থেকে যে, ধৈর্য হারালে চলবে না।
সময় অনেকটা গেলেও, মাঝে ছবি করেছেন?
হ্যাঁ, ‘ওসিডি’ তৈরি। ‘কালান্তর’-এর পোস্ট চলছে। আর ‘পক্ষীরাজের ডিম’-এর ফাইনাল পোস্ট প্রোডাকশন চলছে। আসলে মানুষকে কাজগুলো দেখাতে না পারলে, প্রশংসা না পেলে উদ্যম কমে যায়। তখন আবার ভিতর থেকে নিজেকে জাগাতে হয়, সেটা একটু ক্লান্তিকর প্রসেস।
‘ভূতপরী’-র ট্রেলার তো খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছে। সাড়া কেমন পেলেন?
সাড়া কিন্তু ভালোই। লোকজন যেটা বেশি বলছে, শেষ দৃশ্যে জয়ার যে লেভিটেশন (শূন্যে উত্থান) দেখানো হচ্ছে, ওটা নতুন লাগছে। আর দুটো সংলাপ, একটা হচ্ছে – ‘ভূত মরে পরী হয়।’ আর সবচেয়ে বেশি লোকে আমাকে বলেছে ‘মানুষ-ফানুস’, ‘ভূত-ফুত’-এর জায়গাটার কথা।
জয়া আহসান তো আপনার ছবিতে নিয়মিত হয়ে গিয়েছেন। কী করে সম্ভব করলেন?
‘ভূত পরী’ জয়ার সঙ্গে আমার প্রথম কাজ। জয়া খুব সাহসী। মনে আছে, আমরা এমন জায়গায় শুট করেছি, পঞ্চায়েত থেকে বোর্ড দেওয়া আছে যে– এখানে বিষধর সাপ আছে। সেখানে রাত্রিবেলা শুট, বোলপুর আর পশ্চিম বর্ধমানের কাছাকাছি জায়গায়। ওইখানে জয়া খালি পায়ে রাত্রিবেলা পড়ে যাওয়া, শুট করা– সব কিছু করেছে। আমি যে ধরনের ছবি বানাই নির্ভীক শিল্পী আমার খুব দরকার। তখন থেকেই জয়ার সঙ্গে দারুণ জেল করে যাই আমি এবং গোটা ইউনিট।
‘ভূতপরী’-তে ঋত্বিক চক্রবর্তী ‘মাখন চোর’-এর চরিত্রে। আপনার সঙ্গে তো প্রথম কাজ?
হ্যাঁ, এটাই একমাত্র এখনও পর্যন্ত। ঋত্বিকদাকে আমি বহুদিন চিনি। প্রথম ছবি বেরনোর আগে থেকে। আমার প্রতি ওঁর একটা স্নেহ কাজ করে, এটা আমি বুঝি। ঋত্বিকদা যে স্কিল সেটে অভিনয় করার চেষ্টা করে, সেটা ফ্লোরের শুটিংয়ে সুইচ অন করে, তারপরে আবার অফ করে দেয়। এটায় তো গ্রামের সিঁধেল চোরের গল্পের জায়গায় ঋত্বিকদা, এখানে ঋত্বিকদাকেই দরকার ছিল। লীলা মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় পড়ে ঋত্বিকদার বেড়ে ওঠা, ফলে ওটা ওর মধ্যে আছে। ঠিক সেভাবেই অ্যাপ্রোচ করেছে ‘মাখনচোর’-কে, খুবই বাঙালি। মনে হয়, দর্শকের ভালো লাগবে।