‘শিবপুর’ মুক্তি ৩০ জুন। তিক্ততা, বিতর্ক সবকিছুর পরেও নিজের ছবি নিয়ে কথা বললেন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
‘শিবপুর’ ছবির ট্রেলার মুক্তি পেয়েছে। খুবই প্রশংসিত হচ্ছে। আপনাকে তো দুর্দান্ত লাগছে!
স্বস্তিকা: আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোর একটা হল ‘শিবপুর’। কারণ প্রথমত বাংলায় গ্যাংস্টার নিয়ে খুব একটা কাজ হয় না। ইদানীং বাংলা সিনেমায় হয় গোয়েন্দা, নয় পারিবারিক গল্প দেখছি। এটা তার বাইরে গিয়ে করা। দ্বিতীয়ত, মধ্যবিত্ত বাড়ির বিবাহিত মহিলা যে বিধবা হওয়ার পর একজন গ্যাংস্টার হয়ে উঠছে, লড়াই করছে এবং যে সময়টা ধরা হয়েছে, সব মিলিয়ে ইনক্রেডিবল একটা ব্যাপার। পরিচালক অরিন্দম ভট্টাচার্য যখন প্রথম ছবিটার স্ক্রিপ্ট শোনান আমি বলেছিলাম, আমি করব। কারণ, মন্দিরা বিশ্বাসের মতো চরিত্র আগে করিনি, আর পারফর্ম করার অনেক সুযোগ রয়েছে। দ্য গ্রাফ অফ মাই ক্যারেক্টার ইজ শার্প অ্যাজ নাইফ! অন্য বাঘা-বাঘা ডনদের ছাপিয়ে যায় ‘মন্দিরা’। আমাদের সকলের মধ্যে হয়তো এই অসম্ভব শক্তি থাকে। মা-ও তাই বলত, ঠেকায় পড়ে সব শিখে যাবি। ঠেকায় পড়ে জীবনে অনেক কিছুই শিখেছি।
‘শিবপুর’-এ ভায়োলেন্স আছে। অ্যাকশন দৃশ্যে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা কেমন?
স্বস্তিকা: এই ব্যাপারটা আমার কাছে একেবারেই নতুন। অনস্ক্রিনে আগে কখনওই গোলাগুলি চালাইনি! আশা করি পর্দায় সেটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পেরেছি। সেই চেষ্টাই করি সবসময়। শুটিংয়ের সময় মনে আছে গলায় বারুদের ধোঁয়া ঢুকে, ভয়েসটা চোকড হয়ে গিয়েছিল। একটা পুজোবাড়ির দৃশ্যে ডায়লগ বলেছি কোনওমতে। কিউ দিতে গিয়ে গলায় কোনও জোর নেই। পরমব্রত আমার হয়ে কিউ দিয়েছিল। টানা গোলাগুলির সিন চলেছে পাশাপাশি। অভ্যস্ত নই একেবারেই! ‘মন্দিরা’ অস্ত্রচালনায় পটু নয়, সেও শিখেছে সময়ের প্রয়োজনে। আর অভিনেতা হিসাবে আমিও শিখেছি ‘মন্দিরা’-র হাত ধরেই। কারণ কেরিয়ারের শুরুর দিকের ছবিতে নায়কের হাতে বন্দুক থাকত, আর নায়িকা হয়ে আমি ভয়ে সিঁটিয়ে থাকতাম– এটাই চল ছিল (হাসি)।
[আরও পড়ুন: ‘হিন্দিতে কেউ কাজ দেয় না’! রাইমার আক্ষেপ শুনেই ডাক দিলেন বিবেক অগ্নিহোত্রী]
‘মন্দিরা বিশ্বাস’-এর মতো চরিত্র কতটা এগজসটিং?
স্বস্তিকা: আমি সবসময়ই খুব এগজসটিং, ইনটেন্স চরিত্রের অফার পেয়ে এসেছি। এই ছবিটা ফিজিক্যালিও খুব টাফ ছিল।
বারবার এই ধরনের ইনটেন্স চরিত্রের দিকে নিজেকে ঠেলে দিয়ে বেরিয়ে আসার অভিজ্ঞতা কেমন?
স্বস্তিকা: ‘শিবপুর’-এর ক্ষেত্রে এই মন্দিরা বিশ্বাসের জিতে যাওয়াটা আমি খুব এনজয় করেছি। যারা আমার ক্ষতি করেছে, তাদেরও যে ক্ষতি হওয়া সম্ভব– এইটা এই চরিত্রের মধ্যে দিয়ে জানতে পেরে স্বস্তি হয়েছে। এখানে আমি অনেকটা ‘অ্যাভেঞ্জার্স’-এর মতো। অভিনয় পেশার একটা দারুণ দিক হল, ব্যক্তিগত জীবনের কিছু-কিছু না-পাওয়া একটা চরিত্রের মধে্য দিয়ে মিটিয়ে নেওয়া যায়! হয়তো শুটিং চলাকালীন এক মাস, পনেরো দিনের জন্যই পেলাম! তাও তো পেলাম! জীবনে কত মানুষ ক্ষতি করে চলে যায়। তাদের হয়তো আমরা মনে-মনে গালাগালি দিই, আর কিছুই করে উঠতে পারি না। মানসিকভাবে বা শারীরিকভাবে যা ক্ষতি করেছে সেটাকে পাবলিকলি বলতেও পারি না। আমি হয়তো জানি, যে আমি একটা অ্যাবিউজড সম্পর্কে ছিলাম, কিন্তু সেটা নিয়ে কথা বলতে পারব না কোনওদিনই। বললেই কেবল মিডিয়া হাইপ হয়ে আমাকে নিয়ে টানাটানি হবে, আসল উদ্দেশ্য হারিয়ে যাবে। তাই হয়তো আমি বলেই উঠতে পারলাম না, যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছবি দেখে সুন্দর লাগলেও, ভিতরটা খুবই অন্ধকার এবং ধ্বংসস্তূপের মতো। এবার একটা চরিত্রের মধ্য দিয়ে যদি এমন কোনও একটা মানুষের প্রতি রিভেঞ্জ নিতে পারি, তাহলে একটা স্বস্তি হয়।
‘শিবপুর’ ছবিটা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। ট্রেলার লঞ্চে পরিচালক আমন্ত্রণ পেলেন না! এই নেগেটিভ পাবলিসিটি কি ছবিটার ক্ষেত্রে ওয়র্ক করবে?
স্বস্তিকা: দেখ ‘বিতর্ক’ শব্দটাতে আমার আপত্তি আছে। কোনও একটা ইসু্যকে অ্যাড্রেস করলেই যদি ‘বিতর্ক’-র অাওতায় পড়ে যায় তাহলে তো মুশকিল। এখানে কোনও বিতর্কের জায়গা নেই। যেটা অন্যায় সেটা নিয়ে কথা বলা মানেই যদি ‘বিতর্ক’-র নাম দিয়ে লেবেলিং করে দেওয়া হয় তাহলে আমি প্রতিবাদ করলেও অন্য অভিনেত্রীরা তো মুখ খুলবে না ভয় পেয়ে! যা বলেছি সব ফ্যাক্ট! আর আজ পর্যন্ত আমি ওদের কোনও ‘মার্কেটিং প্ল্যান’ হাতে পাইনি যেটাতে আমি ‘যদি না যাই’ বলে এত কাণ্ড হল! ‘শিবপুর’-এ অভিনয় করার সময় যে ভালবাসা ছিল, উত্তেজনা ছিল, এখন এটা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আমি দ্বিধাবিভক্ত। অভিনেত্রী হিসাবে আমি নিশ্চয়ই চাইব ছবিটা দর্শক দেখুক, চলুক কিন্তু একজন নারী হিসাবে নির্মাতাদের পক্ষ থেকে যে যৌন হেনস্তা হয়েছে সেটা মেনে নিতে পারছি না!
আপনি আগেও প্রাক্তনদের সঙ্গে কাজ করেছেন। পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অনেকদিন পর কাজ করলেন। কেমন অভিজ্ঞতা?
স্বস্তিকা: ছবিতে আমাদের একসঙ্গে খুব বেশি দৃশ্য নেই! তাছাড়া ও পুলিশ আমি ডাকাত। ধরা দেব না (হাসি)।
হা হা হা..হ্যাঁ, মানে চোর-ডাকাতের লুকোচুরি খেলা…
স্বস্তিকা: হ্যাঁ, সেটাই। কেবল পরম নয় খরাজদা, রনিদা (রজতাভ দত্ত)– সবার সঙ্গেই অনেকদিন পর কাজ করলাম। একটা রিইউনিয়ন হল!
সম্প্রতি সুমন মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে সুন্দর একটা পোস্ট দিয়েছেন। ট্র্যাফিক জ্যাম এবং তিক্ততা পেরিয়ে ভাল দিক মনে রাখার কথা বলেছেন। খুবই ইমোশনাল! যদিও অনেকে ইমোশনকে দুর্বলতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন…
স্বস্তিকা: একজন শিল্পী হিসাবে আমি যদি ইমোশনাল না হই, তাহলে তো ভাল আর্টিস্ট হতে পারব না। আর আমার যে পেশা সেখানে আমার ইমোশনটাই আমার সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। আমার অনুভূতিকে ব্যবহার করে আমার চরিত্রগুলোকে জীবন্ত করে তুলতে পারি। অনেকে বলেছে, ‘তোমাকে স্ট্রং ভাবতাম, কিন্তু তুমি যে খুব ইমোশনাল।’ আরে ইমোশন এবং স্ট্রেন্থ-এর কোনও বিরোধ নেই এটা লোকে বোঝে না! দিজ আর নট ইন কনফ্লিক্ট! আর সমাজের ঠিক করে দেওয়া সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেলেও আমি সুমনের পরবর্তী সব কাজই দেখেছি। ‘আজকের সাজাহান’ ও দেখতে গিয়েছিলাম। জীবনে এটাই বিশ্বাস করি এবং আমার মেয়েকেও বলেছি– সাত বছর বা দশ বছরের সম্পর্কের পর দু’-বছর কথাবার্তা না-ও হতে পারে, দেখা না-ও হতে পারে, কঠিন সময়ে একে অপরের পাশে না-ই থাকতে পারি! কিন্তু তারপর তিন বছর পেরিয়ে যখন দেখা হল, পুরনো তিক্ততা সরিয়ে, একে অপরকে শিল্পী হিসাবে শ্রদ্ধা এবং উষ্ণতা দেখাতে পারা– এইটুকুই জীবনের পাওয়া। এই যে সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর বাকি জীবনটা আমি তোমার নামটা তিক্ততার সঙ্গে উচ্চারণ করলাম না– সেটাই যথেষ্ট! কারণ পুরনো সম্পর্কের তিক্ততা পুষে রাখলে যন্ত্রণা আমারই। আমাদের সকলের বয়স হচ্ছে। যার সঙ্গে এতটাই হৃদ্যতা ছিল, তার সঙ্গে দেখা হলে যদি দু’দণ্ড আড্ডা দিতে পারি সেটাই অনেক।
অন্বেষা আর আপনার বন্ধুত্বটা দারুণ লাগে। ও অনেকটা আপনার মতোই ফ্রি স্পিরিটেড। হাতে ধরে শিখিয়েছেন!
স্বস্তিকা: হ্য়াঁ, মানির (অন্বেষার ডাকনাম) সঙ্গে সব কিছুই শেয়ার করতে পারি। এখন তো ও আমাকে শাসন করে! মানিকে আলাদা করে হাতে ধরে কিছু শেখাতে হয়নি। আর আমি সবসময় বলি আমরা একসঙ্গে বড় হয়েছি। ও দেখেছে আমাকে কেউ চরম বদনাম করার পরও আমি গিভ ইন করিনি। আর লোকে চেষ্টা তো কম করেনি। কুৎসা রটানো, বদনাম রটানো সবই করেছে! বাবা খুব বলতেন, দাঁত কামড়ে পড়ে থাক, ঠিক বেরিয়ে আসবি! তো সেটা আমি খুব ভালভাবে রপ্ত করেছি!