বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান। অবশেষে বিলুপ্তপ্রায় মাতৃভাষা রক্ষার দুয়ার খুলে গেল উত্তরের রাজবংশী তথা কামতাপুরী সমাজের সামনে। এতদিন যা ছিল নেহাতই স্বপ্ন এখন সেটাই বাস্তব। রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষা বাম জমানার ‘উপভাষা’ বিতর্কের অবসান করে ভাষার মর্যাদা আদায় করে নিয়েছে কয়েক বছর আগেই। এবার উত্তরের নতুন প্রজন্মের ভূমিপুত্ররা নিজস্ব ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। পঠনপাঠনের হাত ধরে সমৃদ্ধ হবে ওই জনজাতি সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতি। এ যেন স্বপ্নের উড়ান।
কেন্দ্রীয় সরকার সংবিধানের অষ্টম তফসিলভুক্ত করার বিষয়ে এখনও পদক্ষেপ না- করলেও অ্যাকাডেমি গঠন করে আগেই রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষাকে মান্যতা দিয়েছে রাজ্য সরকার। সোমবার কোচবিহারের প্রশাসনিক সভা থেকে রাজবংশী ভাষার ২১০টি স্কুলের উদ্বোধন করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার অবলুপ্তির হাত থেকে ওই ভাষা রক্ষার পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে দিলেন এমনই মনে করছেন রাজবংশী বিদ্বজ্জনদের একাংশ।
[আরও পড়ুন: প্রতারিত সলমন খান! কোন ফাঁদে পড়লেন বলিউডের সুলতান?]
যেমন, রাজবংশী ভাষা পাঠ্য পুস্তক সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান তথা রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য দীপক রায় বলেন, “স্কুলগুলো বিলুপ্তপ্রায় ভাষা রক্ষায় কবজের মতো কাজ করবে। বলা চলে রাজবংশী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির এটা প্রথম ধাপ। এর ফলে ভাষার চর্চা বাড়বে। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মতো রাজবংশী ভাষা পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। সেটা হলে আরও ভালো হবে।” জানা গিয়েছে, চলতি শিক্ষাবর্ষে স্কুলগুলোতে পুরোদমে শুরু হয়ে যাবে। বেসরকারি উদ্যোগে উত্তরের বিভিন্ন জেলায় ২০১১ সাল থেকে স্কুলগুলো চলছে। এখন সেগুলোই সরকারি স্কুলের মর্যাদা পাচ্ছে। নভেম্বর মাস থেকে সেখানে নিযুক্ত শিক্ষকেরা রাজ্য শিক্ষা দফতরের নিয়োগপত্র পেতে শুরু করেছেন। ৩৯৪ জন পার্শ্বশিক্ষক এবং ৩৮৫ জন শিক্ষাকর্মী নিয়োগের কাজ চলছে।
তবে এতো বড় কর্মকাণ্ড কোনও একদিন হঠাৎ হয়নি। ২০১১ সাল থেকে সেটার সলতে পাকানো শুরু হয়। যদিও রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি আজকের নয়। রাজনৈতিক মহলের মতে সেই ষাটের দশক থেকে ওই দাবিতে উত্তরখন্ড, উতজাস-সহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন আন্দোলন গড়ে তুলেছে। ১৯৯৬ সালে কামতাপুর পিপলস পার্টি এবং ২০০৫ সালে অল কামতাপুর স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আকসু) গঠনের পর ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলন অন্য মাত্রা পায়। রক্ত ঝরে। কিন্তু বামফ্রন্ট জমানায় ভাষার দাবি মান্যতা পায়নি। উলটে রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষা নয়। উপভাষা মাত্র এমনই তত্ত্ব সামনে রেখে আন্দোলন ও দাবি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলে বলে অভিযোগ। যদিও উত্তরের আট জেলায় রাজবংশী জনসংখ্যা পাঁচ লক্ষাধিক।
[আরও পড়ুন: দুয়ারে চিতার আতঙ্ক, ভয়ে কাঁটা পুরুলিয়ার বাসিন্দারা]
গবেষকদের একাংশ জানান, মালদহ এবং দুই দিনাজপুরের পোলিয়া, দেশিয়ারাও রাজবংশী। সেই হিসেব ধরা হলে সংখ্যা দশ লক্ষের কাছাকাছি দাঁড়াবে। ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে তাদের নতুন প্রজন্ম মরিয়া আন্দোলনে নামেন। কিন্তু বাম আমলে প্রাপ্তি কিছুই মেলেনি। পরিস্থিতি পালটায় রাজ্যে পালা বদলের পর। রাজবংশী তথা কামতাপুরী ভাষায় যে স্কুলগুলো বিভিন্ন গ্রামে চলছিল সেখানে পঠনপাঠনের মান ঠিক রাখতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেটা ২০১১ সালে। ওই কমিটিতে ছিলেন দীপক রায়, নিখিল রায়, কেনেডি রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বর্মা প্রমুখ। দীপকবাবু জানান, মাসের পর মাস শিক্ষকদের রাজবংশী ভাষার উচ্চারণ, পড়ানোর কৌশল সহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এক দশক পর ২০২১ সালে রাজ্য সরকারের নির্দেশে গঠিত হয় ২৯ জন বিশেষজ্ঞকে নিয়ে রাজবংশী ভাষায় পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস কমিটি। তিন বছরের চেষ্টায় চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত সিলেবাস তৈরি এবং বই লেখার কাজ শেষ হয়। সিলেবাস কমিটির চেয়ারম্যান জানান, বাংলা হরফে রাজবংশী ভাষায় বইগুলো লেখা হয়েছে। নামকরণও রাজবংশীতে হয়েছে। যেমন, শিশুপাঠের নাম ‘ছাওয়ালি পাঠ’। ভাষা ও সাহিত্য পাঠে জায়গা পেয়েছে বাচ্চামোহন রায়, গিরীজাশঙ্কর রায়, সন্তোষ সিংহের মতো স্থানীয় রাজবংশী লেখকদের কবিতা, ছড়া, গল্প। রয়েছে ব্যাকরণ, বিজ্ঞান, অঙ্ক। ইতিমধ্যে ২০টির মতো বিষয়ের বই প্রকাশিত হয়ে স্কুলে পৌঁছনোর কাজ চলছে। প্রায় ১২ হাজার পড়ুয়া এখন রাজবংশী ভাষায় পড়ার সুযোগ পাবে।
রাজ্যের এমন উদ্যোগে খুশি ভাওয়াইয়া রত্ন কামেশ্বর রায়। তিনি বলেন, “সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে রাজ্য সরকার স্কুলগুলো চালু করেছে। এটা ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।” লোকসংস্কৃতি গবেষক দীনেশচন্দ্র রায় বলেন, “রাজ্যের এই পদক্ষেপে রাজবংশী ভাষা রক্ষা পাবে।” যদিও কামতাপুর পিপলস পার্টির নেতৃত্ব মোটেও উচ্ছ্বসিত নয়। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নিখিল রায় বলেন, “সামনে লোকসভা নির্বাচন। এটা নিছকই রাজনৈতিক চমক কিনা সেটা দেখতে হবে।”