রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ভেনিসের গন্ডোলা। মুম্বইয়ের লোকাল ট্রেন। লন্ডনের আন্ডারগ্রাউন্ড। পৃথিবীর তিন প্রান্তের তিন শহরকে যে ভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে এই তিন যানবাহন পরিষেবা নেটওয়ার্কের রেখাচিত্র, বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেওয়ার মতো। মুম্বইয়ে লোকে বাসে-ট্যাক্সির চেয়ে লোকাল ট্রেনে বেশি চড়ে। কলকাতায় প্রাগৈতিহাসিক হয়ে যাওয়া লাল দোতলা বাস লন্ডনে আজও টুকটুকে রাঙা ষোড়শীর মতো অলস ঘোরাফেরা করে বটে, কিন্তু অফিস টাইমের হুড়োহুড়ি কিংবা ছুটোছুটি–বিলেতে যাবতীয় ছুটোছুটি-হুড়োহুড়ির নিশ্চিন্ত আশ্রয় টিউব। কার্ড পাঞ্চ করে টিউবের ছোট-ছোট নীল হাতলওয়ালা সিটে গা এলিয়ে দিলেই হল!
আর শুধু কার্যকারিতাই বা উল্লেখ করা কেন? লন্ডন টিউব চেপে গেলে দৃশ্যেরও তো কত রকম হাতবদল হয়, কয়েকটা স্টেশনের তফাতে পাল্টে যায় পারিপার্শ্বিক, বিপরীতধর্মী ঘটনাবলীর চিত্রপট পেশ করে। এই যেমন বেকারলু লাইনের স্টোনব্রিজ স্টেশন। ছবির মতো সুন্দর, কবিতার মতো মায়াবী স্টেশন। কিন্তু শনিবার দুপুরে সেখানে অন্তত জনা পঞ্চাশেক পুলিশ অফিসারকে দেখা গেল শশব্যস্ত দাঁড়িয়ে। মুখেচোখে একরাশ টেনশন নিয়ে। করবেন কী? গোটা স্টেশন চত্বর যে লাল ধোঁয়ায় ঢাকা পড়েছে, স্থানুবৎ ট্রেনের জানালা-দরজাকে অক্লেশে বাদ্যযন্ত্রে পরিণত করে নিয়েছে শ’য়ে-শ’য়ে, নিজেদের ‘হাতযশে’! যাকে যোগ্য সঙ্গত দিচ্ছে অজস্র হেঁড়ে গলার গগনভেদী গান। আজ এঁরা কেউ নীল। আজ এঁরা কেউ লাল। আজ এঁরা কেউ সিটি। আজ এঁরা কেউ ইউনাইটেড। কিছু করার নেই যে, ওয়েম্বলিতে আজ ফুটবল আছে, ফুটবল!
[আরও পড়ুন: রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে ‘নিঃশব্দে’ সরে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর, আজও স্মরণীয় সেই ইতিহাস]
ফুটবল-আবেগ মনুষ্য কণ্ঠনিঃসৃত ভাষার পরোয়া কোনও দিনই করেনি। তার স্বতন্ত্র পাগলাটে এক ভাষা আছে। যেখানে অক্ষরের সঙ্গে নানাবিধ ক্রিয়াকলাপও মিশে থাকে চিরকাল। এই যেমন ট্রেনে ম্যাঞ্চেস্টার সিটির যে ‘অ্যায়াম সিটি টিল আই ডাই’ গান বছর ষাটেকের ভদ্রলোক গাইছিলেন, ট্রেনের হাতল ধরে অফুরান আনন্দে দোল খেতে তাঁকে দু’বার ভাবতে হয়নি! কিংবা স্টোনব্রিজ স্টেশনে পুলিশি তাড়াকে অগ্রাহ্য করে সিটি সমর্থকদের খেলার আগেই যে ভাবে বিজয়োৎসব চলল, একমাত্র ফুটবল অভিধান বাদে তার কোনও ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কি? টিউব চলাচলই অচল হয়ে গেল কিছুক্ষণ! সাংবাদিক দেখে করুণ গলায় এক ব্রিটিশ পুলিশ বলেও ফেললেন, “ওয়েম্বলিতে আজ যাচ্ছে পঁচাশি হাজার, আর পুলিশ রয়েছে হাজার। সামলাব কী করে?” ওয়েম্বলির দিকে হাঁটতে হাঁটতে আবার দেখা গেল, অন্তত একশো পুলিশ কর্ডন করে নিয়ে যাচ্ছে ইউনাইটেড সমর্থকদের! ঠিক পড়লেন, রীতিমতো ‘কর্ডন’ করে! পাছে সিটি সমর্থকদের সঙ্গে হাতাহাতি বাঁধে!
রাস্তার পাশের পাবগুলো দেখা গেল সগর্বে ‘ইট, ড্রিঙ্ক অ্যান্ড ডান্স’-এর বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছে, তিলধারণের জায়গা নেই ভেতরে, বরং মুহুর্মুহু উল্লাস-গর্জন ছিটকে আসছে বাইরে, ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে পথচারীকে। জেফ নামের এক জার্সি-স্কার্ফ বিক্রেতাকে (যিনি ইউনাইটেড ও সিটি, দুইয়ের সামগ্রী বিক্রিতে ব্যস্ত ছিলেন) দেখলাম মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে গেলেন, “সিটি (Manchester City) জিতছে আজ। আমি অ্যাস্টন ভিলা সমর্থক। কিন্তু আজ সিটি! তাতে ইউনাইটেড জার্সি বিক্রি হোক চাই না হোক।” কী নাম দেবেন এই আবেগের? কী বলবেন জনৈক সিটি সমর্থককে, যিনি সাংবাদিকের ভিডিও ক্যামেরা দেখে মাইকেল জ্যাকসনের ‘মুনওয়াক’ নেচে গেলেন!
এফএ কাপ ফাইনালে সিটির কাছে ইউনাইটেড ১-২ হেরে গেল। দু’টো টিমের শক্তি ও ফর্ম বিচারে এই রেজাল্ট আশ্চর্যজনক নয়। আশ্চর্যজনক বরং, ওয়েম্বলি থেকে কয়েকটা স্টেশন দূরে আর একটা স্টেডিয়ামের ছবি। যে স্টেডিয়ামে আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে জন্ম অ্যাসেজের, যে স্টেডিয়াম সাক্ষী থেকেছিল ইংল্যান্ডের ভূমিতে প্রথম টেস্ট ম্যাচের। ওভাল– ‘দ্য হোম অব দ্য টেস্ট ম্যাচ’!
[আরও পড়ুন: ১০ দলিত খুনে সাজা চার দশক পর, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ৯০-এর বৃদ্ধের]
আগামী ৭ জুন থেকে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের (World Test Championship Final) ফাইনালের আসর বসছে ওভালে। যেখানে সম্মুখসমরে নামবে রোহিত শর্মার ভারত এবং প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া। ভারতীয় টিম এ দিনই কেন্ট থেকে লন্ডনে এসে পৌঁছল। নাহ্, ঘণ্টা কয়েক ট্র্যাভেল করে আসার পর আর এ দিন ওভালে আসেননি দ্রাবিড়-রোহিতরা। বরং বিরাট-অনুষ্কা-শুভমান-সূর্যরা সদলবদলে চলে গেলেন এফএফ কাপ (FA Cup Final) ফাইনাল দেখতে। এবং এ দিন ওভাল-তল্লাটে ঘোরাফেরা করে এমন কোনও দৃশ্য ধরা পড়ল না, যা কি না আসন্ন শিরশিরানির ইঙ্গিতবাহী। ওভালের উলটোদিকে একটা ট্র্যাভেলজ তৈরি হচ্ছে। ক্রিকেট-তীর্থ করতে এসে সমর্থকদের যাতে থাকা নিয়ে অসুবিধেয় না পড়তে হয়। একটু এগোলে নিস্তেজ ওভাল টিউব স্টেশন। ততধিক নিস্তরঙ্গ ওভাল কাফে। রাস্তার উলটো দিকে সেন্ট মেরি’জ চার্চ। সেখানে শনিবার বলে ‘ফার্মার্স মার্কেট’ বসেছে। ফল-মূল-সব্জি বিক্রি চলছে। ক্রিকেট কোথায়, ক্রিকেট?
অথচ ক্রিকেট আছে। ভাল রকম আছে। যেমন ওভাল পিচ একটা চর্চার বিষয়। ভারতীয় টিম (Indian Cricket Team) কম্বিনেশন একটা চর্চার বিষয়। শোনা যাচ্ছে, ওভালে দুই স্পিনারে নাকি যেতে পারে ভারত। রবীন্দ্র জাদেজার সঙ্গে সেক্ষেত্রে রবিচন্দ্রন অশ্বিন। কারণ, ওভালের পিচ নাকি বেশ শুকনো। অস্ট্রেলিয়ার প্রখ্যাত সাংবাদিক গিডিয়ন হেইগের মত হল, ওভাল পিচে স্পিনাররা সব সময় মানসিক সুবিধে পেয়ে থাকে। তৃতীয় সিমার যা পায় না। অর্থাৎ, সেটা হলে আর ভারত দুই স্পিনারে গেলে ওভালের টেস্ট ফাইনালে পরিষ্কার ‘অ্যাডভান্টেজ ইন্ডিয়া’। সেই ‘অ্যাডভান্টেজ’কে আবার ‘ডিউস’ করতে পারতেন যিনি, সেই ডেভিড ওয়ার্নার নিজে কতটা মানসিক ভাবে ভাল জায়গায় আছেন, বলা মুশকিল। কারণ, ওয়ার্নার এ দিন ঘোষণা করে দিয়েছেন যে, আগামী বছর জুনের মধ্যে ক্রিকেটের সমস্ত ফর্ম্যাট থেকে সরে যাবেন। শেষ টেস্ট খেলবেন আগামী বছরের জানুয়ারিতে। কী বোঝা গেল?
[আরও পড়ুন: রেল দুর্ঘটনার দায় নিয়ে ‘নিঃশব্দে’ সরে গিয়েছিলেন লালবাহাদুর, আজও স্মরণীয় সেই ইতিহাস]
শনিবাসরীয় লন্ডন ফুটবলের ছিল, জিতেওছে ফুটবল। ক্রিকেট তো ময়দানে নামেনি এখনও। তবে নামবে, রোববার থেকে নামবে সে। যখন ব্যাট নামক ব্রহ্মাস্ত্র নিয়ে ট্রেনিংয়ে নামবেন বিরাট রাজা, হাতের লাল বলে শান যখন আরও কিছুটা দিয়ে নেবেন কামিন্স। আরে যতই হোক, এই দেশ ক্রিকেটের জন্মভূমি। গর্ভধারিনী। সেখানে রোজ রোজ ক্রিকেট হারবে নাকি?