বিশ্বদীপ দে: দেখতে দেখতে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় তিনটে বছর। ফের জনজোয়ারে ভেসেছে পুরীর (Puri) জগন্নাথধাম (Jagannath Temple)। রথে চড়ে জগন্নাথ, বলরাম এবং সুভদ্রার মাসির বাড়ি শ্রীগুণ্ডিচা মন্দির যাত্রা প্রত্যক্ষ করতে নেমেছে মানুষের ঢল। অতিমারীর প্রকোপে ২০২০ ও ২০২১ সালে রথযাত্রা হলেও সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না। এবার উঠে গিয়েছে নিষেধাজ্ঞা। স্বাভাবিক ভাবেই উৎসাহ তুঙ্গে। তবে কেবল রথযাত্রাই নয়, সারা বছরই ভক্ত সমাগম লেগে থাকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। কিন্তু সকলের জন্য এই মন্দিরের দ্বার অবধারিত নয়। কেবল মাত্র হিন্দুরা ছাড়া আর কেউ প্রবেশাধিকার পান না এখানে। এযাবৎ বহু বিখ্য়াত মানুষকে ফিরে যেতে হয়েছে মন্দিরের দ্বারপ্রান্ত থেকে। কারা কারা রয়েছেন তালিকায়? একবার ফিরে দেখা যাক সেই ইতিহাসকেই।
১) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore)- পুরী মন্দিরে ঢুকতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথও। কিন্তু পারেননি। বিশ্বকবির সঙ্গে ওড়িশার সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। আসলে ওই রাজ্যেও জমিদারির অংশ ছিল দ্বারকানাথ ঠাকুরের। সেই জমিদারির পরিদর্শনে বারবার পুরী যেতে হত রবীন্দ্রনাথকে। কিন্তু এতবার সেখানে গেলেও পুরীর মন্দিরে ঢোকা হয়নি তাঁর। আসলে রবীন্দ্রনাথ যে ছিলেন ব্রাহ্ম। নিরাকারের উপাসক। তার উপর ঠাকুর বংশের পিরালি ব্রাহ্মণত্বের বিতর্কও ছিল আরেকটা ফ্যাক্টর। এই সব কারণেই পুরীর মন্দিরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি তাঁকে।
[আরও পড়ুন: ভাগ্য ফেরাতে চান? রথযাত্রার দিন এই নিয়মগুলি আপনাকে মানতেই হবে]
২) মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi)- সাল ১৯৩৪। পুরী এসেছেন মহাত্মা গান্ধী। তাঁর সঙ্গে বিনোদা ভাবে। খ্রিস্টান, মুসলিম, দলিতদের সঙ্গে নিয়ে পুরীর মন্দিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাঁদের। সেইমতো দল বেঁধে তাঁরা এগিয়েও চলেন মন্দির অভিমুখে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর উদ্দেশ্য সফল হয়নি তাঁর। যদিও মন্দির কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রবেশাধিকার রদ করেনি। তবে তাদের বক্তব্য ছিল, একা প্রবেশ করতে পারবেন গান্ধী। কিন্তু তাঁর সঙ্গে থাকা বিধর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হবে না। এই ঘটনায় অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন ‘জাতির জনক’। পরে মন্দিরের মূল ফটক থেকে হরিজনদের নিয়ে বিরাট পদযাত্রা করেছিলেন। আসলে অস্পৃশ্যতাকে কোনওদিনই মেনে নিতে পারেননি গান্ধী। তবে তিনি প্রবেশ না করলেও গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরবা কিন্তু গিয়েছিলেন পুরীর মন্দিরে। এই ঘটনায় মারাত্মক আহত হয়েছিলেন তিনি। এমনকী তাঁর রক্তচাপও নাকি বেড়ে গিয়েছিল।
৩) ইন্দিরা গান্ধী– এই তালিকার অন্যতম নাম ইন্দিরা গান্ধী। তাঁকেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি পুরীর মন্দিরে। ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গিয়েছিলেন পুরীতে। কিন্তু দেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি এই মন্দিরে ঢুকতে পারবেন না। আসলে জওহরলাল নেহরুরা ছিলেন কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ। তাই জন্মগত ভাবে ইন্দিরা ব্রাহ্মণ। কিন্তু তিনি বিয়ে করেছিলেন ফিরোজ গান্ধী। আর বিয়ের পরে মেয়েদের গোত্র, বর্ণ, ধর্ম বদলে যাওয়ার সংস্কারের ফলে ইন্দিরাও বিয়ের পরে হয়ে যান অ-হিন্দু। যদিও প্রাথমিক ভাবে পুরোহিতরা ভেবেছিলেন, ইন্দিরা বোধহয় কোনও ‘হিন্দু’ গান্ধীকেই বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু পরে জানা যায়, বিষয়টা তা নয়। আর তারপরই ইন্দিরাকে জানিয়ে দেওয়া হয়, মন্দিরে প্রবেশাধিকার নেই তাঁর।
৪) লর্ড কার্জন– মন্দিরে প্রবেশাধিকার পাননি লর্ড কার্জনও। ১৮৮৯ থেকে ১৯০৫ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ব্রিটিশ ভাইসরয়। সেই পরাধীন ভারতবর্ষে শাসকদের একজন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রতিনিধিকেও প্রবেশাধিকার দেয়নি পুরীর মন্দির। ১৯০০ সালে তিনি সেখানে প্রবেশ করতে চাইলে তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বিধর্মীদের এই মন্দিরে ঢোকার নিয়ম নেই।
[আরও পড়ুন: আরও মহার্ঘ সোনা, চাহিদায় লাগাম দিতে আমদানি শুল্ক বাড়াল কেন্দ্র]
৫) বি আর আম্বেদকর– দলিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আম্বেদকর। আর সেই কারণেই ১৯৪৫ সালে তাঁকে পুরীর মন্দিরের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, তাঁর সঙ্গে ছিলেন শেষ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেনও। কিন্ত শেষ পর্যন্ত মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি আম্বেদকরকে।
৬) গুরু নানক– জানা যায়, পুরীর মন্দিরে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়নি গুরু নানককেও। ১৫০৮ সালে তিনি এসেছিলেন পুরীতে। সঙ্গী ছিলেন শিষ্য মারদানা। কিন্তু তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। যদিও পরে তিনি ও সমস্ত শিখ ধর্মাবলম্বীরাই অনুমতি পেয়েছিলেন। এর পিছনে ছিল একটা স্বপ্ন। পুরীর রাজাকে স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন স্বয়ং জগন্নাথদেব। স্বাভাবিক ভাবেই এরপরে আর গুরু নানকের জগন্নাথ মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেওয়ার উপায় ছিল না।
৭) এলিজাবেথ জিগলার– তিনি সুইজারল্যান্ডের বাসিন্দা। তবু পুরীর মন্দিরে অনুদান দিয়েছিলেন ১ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকার। কোনও সংগঠন নয়, একা কোনও মানুষের এত বেশি পরিমাণে দান, মন্দিরের ইতিহাসে আর নেই। অথচ সেই এলিজাবেথও প্রবেশাধিকার পাননি এখানে। তিনিও যে হিন্দু ছিলেন না। ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী।
৮) স্বামী প্রভুপাদ– ইসকন ধর্মীয় আন্দোলনের পুরোধা স্বামী প্রভুপাদও প্রবেশাধিকার পাননি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। ১৯৭৭ সালের ২৬ জানুয়ারি তিনি এসেছিলেন এখানে। তবে মহাত্মা গান্ধীর মতো, তাঁকে ব্যক্তিগত ভাবে মন্দিরে প্রবেশে বাধা দেওয়া হয়নি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ছিলেন বহু বিদেশি পর্যটক। তাঁরা যেহেতু হিন্দু নন, তাই তাঁদের নিয়ে প্রভুপাদকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি।