সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘সোনালি তন্তু’ পাট মুর্শিদাবাদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ফসল। গোটা দেশে পাট উৎপাদনে মুর্শিদাবাদ অন্যতম অগ্রণী জেলা। চলতি বছর এই জেলায় প্রায় এক লক্ষ হেক্টর এবং বেলডাঙ্গা-২ নম্বর ব্লকে প্রায় ৩৫০০ হেক্টর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছিল। অন্য ফসলের তুলনায় পাটের তফাৎ বা বৈশিষ্ট্য হল এর বিক্রয়মূল্য নির্ভর করে পাটের তন্তুর গুণগত মানের উপর, ফলন বা উৎপাদনের উপর নয়। তাই পাট পচানোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে যার উপর প্রধানত পাটের গুণগত মান নির্ভর করে।
[আরও পড়ুন: বাড়ির অল্প জায়গায় করুন কালোজিরে চাষ, জেনে নিন পদ্ধতি]
মুর্শিদাবাদ জেলায় বেশিরভাগ কৃষকই পাট পচানোর জন্য গ্রামের পুকুর, ডোবা, খাল, বিল বা নয়ানজুলিকে বেছে নেন। যা মূলত জুন-জুলাই মাসে বর্ষার জলে পুষ্ট হয়। এই জলাশয়গুলি গ্রামবাসীরা তাদের অন্যান্য কাজেও ব্যবহার করেন। ফলে জলদূষণ এবং সংক্রামক রোগব্যাধি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু বর্তমান বছরে জুন-জুলাই মাসে প্রায় ৩৪% বৃষ্টির ঘাটতি রয়েছে। তাই পাট ভেজাতে জলের সংকট প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবে পাটের পচন পদ্ধতি অত্যন্ত শ্রমনির্ভর এবং কৃষি শ্রমিকের পর্যাপ্ত জোগান দরকার। পাট পচানোর জন্য স্থির জলে পাট গাছের কাণ্ড একসঙ্গে আঁটি বেঁধে প্রায় ২০ দিন ডুবিয়ে রাখতে হয়। কিন্তু বর্তমানে অপর্যাপ্ত বৃষ্টির জন্য জলাভাবে চাষিরা প্রথাগত পদ্ধতিতে পাট পচাতে সমস্যায় পড়ছেন। তাছাড়া, কৃষি শ্রমিকের অপ্রতুলতা, অধিক মজুরি, জমি থেকে পাট পচানোর জায়গায় নিয়ে যাওয়ার পরিবহণ খরচ চাষিদের প্রধান সমস্যা। এইসব সমস্যা মোকাবিলায় কৃষি দপ্তরের উদ্যোগে ‘পাটের জমিতেই পাট পচানোর বিকল্প ও উন্নত পদ্ধতি’র প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রদর্শনী ক্ষেত্র আয়োজন করা হচ্ছে।
এই পদ্ধতিতে পাটের জমিতে পাট কাটার পর আয়তাকার বা গোলাকার একটি পচন গর্ত বা রেটিং ট্যাঙ্ক খনন করা হচ্ছে। এক বিঘা জমির পাট পচানোর জন্য প্রায় ৪০ ফুট লম্বা, ৩০ ফুট চওড়া ও চার ফুট গভীর (আয়তাকার) গর্ত খনন করা হচ্ছে। গোলকার হলে ২৬-৩২ ফুট ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট, চার ফুট গভীর গর্ত খনন করতে হবে। পুরো গর্তটি তারপোলিন বা সিলপোলিন (পলিথিন শিট, ৩৬ x ৩৬ ফুট মাপের) দিয়ে মুড়ে দিতে হবে এবং এরপর গর্তটি জল ভরতি করতে হবে। গর্ত খনন করা মাটি চারিদিকে প্রায় এক থেকে তিন ফুট উঁচু করে বাঁধ দিতে হবে। তারপোলিন শিটটি ওই বাঁধের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। তারপোলিন শিট দেওয়ার ফলে জল মাটির নিচে শুষে নেবে না এবং ৮-১০ দিন ওই একই জল থাকবে। ফলে প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় অনেক কম জল লাগবে। এরপর ওই গর্তে পাটের আঁটির দু’টি স্তরে সাজিয়ে রাখতে হবে, একটি স্তর আড়াআড়ি, তার উপরের স্তর লম্বালম্বিভাবে। এইভাবে পাট পচানোর ক্ষেত্র পাট গাছের বয়স ১১০ দিনের মধ্যে হওয়ায় বাঞ্ছনীয়, কারণ এর বেশি বয়স হলে পাট গাছের কান্ডে লিগনিনের মোটা স্তর জমা হয় এবং সেক্ষেত্রে পাটের কান্ড থেকে তন্তু পৃথক করার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়।
[আরও পড়ুন: বর্ষাসুরের দাপট, পুজোর মুখে গাঁদা চাষে ব্যাপক ক্ষতি]
পাট গাছের কান্ড আঁটি বেঁধে জলে ডোবানোর আগে দুই-তিন দিন সোজা করে জমিতে দাঁড় করিয়ে রাখতে হবে যাতে সব পাতা ঝড়ে যায়। জলে ডোবানো অবস্থায় পাটের কাণ্ডের মাঝে লেগুম গোত্রর কোনও উদ্ভিদ, যেমন শন পাতা দিলে পচনের সুবিধা হয়। এছাড়া, লক্ষ্য রাখতে হবে, পচানোর সময় পাটের কান্ড বা আঁটি যেন সরাসরি কলাপতা বা মাটির সংস্পর্শে না আসে, এতে পাটের গুণগত মান কমে যায়। জলে পাট ডোবানোর জন্য সিমেন্টের বস্তার ভিতর মাটি ভরে বস্তা চাপা দেওয়া যেতে পারে। দুটি স্তরের মাঝে ‘ক্রইজাফ সোনা’ পাউডার দিতে হবে। এটি বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার করা পাট পচানোর জীবাণুর সংকলন বা জীবাণু পাউডার। এই পাউডার পাট পচানোর সময় প্রথাগত পদ্ধতির তুলনায় ৮-১০ দিন কমায়, তন্তুর নিষ্কাশন ৮-১০% বাড়ায়, বিঘা প্রতি ৩-৪ কেজি অতিরিক্ত পাটের তন্তু পাওয়া যায় এবং পাটের তন্তুর গুণগত মান বাড়ায়।
পরীক্ষামূলকভাবে দেখা গিয়েছে, এই পাউডার ব্যবহারের ফলে হেক্টরে ৯-১১ হাজার টাকা বেশি আয় হয় চাষির। ‘ক্রাইজাফ সোনা’ পাউডার না পাওয়া গেলে, ঝোলা গুড়, অ্যামোনিয়াম সালফেট বা অন্য কোনও জলাশয় যেখানে পাট পচানো হয়েছে তার নিচের কাদামাটি পাটের স্তরের উপর দিলেও কাজ হবে, পাটের পচনকারী ব্যাকটেরিয়ার জোগান এগুলির মাধ্যমে বজায় থাকবে। পচন সম্পূর্ণ হলে পচন গর্তের জল বার করে দিতে হবে এবং পলিথিন গুটিয়ে নিতে হবে। পলিথিনটি পরের বছরে পাট পচানোর কাজে লাগবে।
The post আধুনিক পদ্ধতিতে পচালে মিলবে ভাল মানের পাট, পরামর্শ কৃষিদপ্তরের appeared first on Sangbad Pratidin.