দেবব্রত মণ্ডল, বারুইপুর: বাগান ভরে লাল হয়ে আছে পাকা রসালো লিচু। সবুজ পাতার মাঝখান দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সাদা সাদা জামরুল। পেয়ারার ভারে নুইয়ে পড়ছে কচি কচি গাছের ডাল। এত ফলন হওয়া সত্ত্বেও বিক্রির জায়গা নেই। আর ফল বিক্রি তেমনভাবে না হওয়ার কারণে ক্ষতির মুখে পড়ছেন হাজার হাজার ফল চাষিরা।
আদি গঙ্গার উর্বর পলিমাটির জন্য দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজপুর, বারুইপুর, কল্যাণপুর, ধপধপি ও কৃষ্ণমোহনপুর-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপকভাবে ফলের চাষ হয়। বাগানের পর বাগান এখন ভরে আছে লিচু, গোলাপজামুন, জামরুল ও পেয়ারা। এখন পেয়ারা সারা বছর পাওয়া গেলেও অন্য ফলমূলের মরশুম এটাই। খুব তাড়াতাড়ি এই পাকা ফলগুলি বাজারজাত করতে না পারলে পেকে পড়ে নষ্ট হবে।
বারুইপুর, কল্যাণপুর, ধপধপি এলাকাতে প্রচুর লিচু চাষ হয়। আছে সব পুরনো পুরনো বিরাট লিচু বাগানও। মূলতঃ ‘বোম্বাই’ লিচু নামে যেটি পরিচিত তা বারুইপুর থেকে পৌঁছে যায় ভারতের বিভিন্ন এলাকাতে। পাড়ার মোড় থেকে শপিং মল, হাটবাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন এলাকায় এই লিচু বিক্রি হয় যথেষ্ট ভাল দামে। মে মাসের প্রথম থেকে শুরু করে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত এই লিচুর জোগান থাকে। কয়েক কোটি টাকার লিচু প্রতি বছর বিদেশে আমদানি হত এই এলাকা থেকে। সৌদি আরব, দুবাই, কাতার এই সমস্ত জায়গাতেই লিচু পেয়ারা আমদানি হয় বারুইপুর থেকে। বিদেশে যেমন আমদানি করা হয় তেমন দেশের মধ্যেও যথেষ্ট চাহিদা আছে বারুইপুরের লিচু, পেয়ারা, জামরুল ও গোলাপ জামুনের। এর মধ্যে সবচেয়ে দামি ফল গোলাপ জামুন। যা বাজারে প্রতি কেজি বিক্রি হয় আড়াইশো থেকে ৩৫০ টাকাতে। বর্তমানে সে গোলাপ জামুন বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকায়। তাও খুব বেশি বিক্রি হচ্ছে এমন নয়। অর্ধেক ফল গাছে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে লিচু পাকার পরে তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে না নামানোর কারণেই ছাল থেকে ফেটে যাচ্ছে। ফলে বেরিয়ে পড়ছে লিচুর দানা ও শাঁস। কয়েকদিনের মধ্যেই এই লিচু বাজারজাত করতে না পারলে পুরোটাই এবার গাছে নষ্ট হয়ে যাবে। তেমনটা আশঙ্কা করছেন ফল চাষীরা।
[আরও পড়ুন: ভিনরাজ্য থেকে হার্ভেস্টর অপারেটর আনার ছাড়পত্র রাজ্যের, লকডাউনে স্বস্তিতে কৃষকরা]
করিম গাজী নামে এক ফল চাষি বলেন, “ফলের উপরেই আমাদের জীবন জীবিকা নির্বাহ হয়। প্রতিবছর লিচু বিক্রি করেই কয়েক হাজার টাকা ঘরে তুলি। আর সেই টাকা দিয়েই সারা বছরের খরচ চালাতে হয়। তার উপর আছে বাগান পরিচর্যা করার খরচ। কিন্তু বর্তমানে সেই লিচু গাছে থেকেই নষ্ট হতে বসেছে। চল্লিশ পঞ্চাশ টাকা করে পাইকারি দামে লিচুর প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে। তাও কেউ কিনতে চাইছে না। এখন যা অবস্থা তাতে এবছর লিচু গাছেই পচে নষ্ট হবে বলে মনে হচ্ছে।”
কল্যাণপুর এলাকায় বেশ কিছু বাগানে গোলাপ জামুন চাষ করা হয়। মূলত মুম্বই, দিল্লি-সহ ভারতের বিভিন্ন এলাকাতে এই গোলাপ জামুন যায় বারইপুর এলাকা থেকেই। সুন্দর সুস্বাদু গন্ধযুক্ত এই ফলটি আপাতত এই এলাকায় যতটা পাওয়া যায় তার বেশিরভাগটাই রপ্তানি হয়ে যায়। এবছর ফল রপ্তানি তো দূরের কথা পাড়ার মোড়ে বিক্রিও হচ্ছে না। যথেষ্ট কম পয়সায় চাষিরা তা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ বেশ কয়েকদিন থাকার পর পাকা ফল গাছ থেকে নিজের ইচ্ছায় ঝরে পড়ে যায়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাই বাজারজাত করতে না পারলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বারুইপুরের ফল চাষি সুজন নস্কর বলেন, “গোলাপ জামুনের চাহিদা সারা ভারতে তো বটেই, বাইরের দেশেও এই গোলাপ জামুন বিক্রি করা হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফল পাকতে শুরু করে। মধ্য মে পর্যন্ত পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে পাড়ার দোকানদাররা কিনে বিক্রি করছেন মাত্র। তাও খুব সামান্যই। বেশিরভাগই গাছ থেকে পড়ে নষ্ট হচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জামরুলও।”
[আরও পড়ুন: কালবৈশাখীর তাণ্ডবে নষ্ট ধান, ফসল ঘরে তোলার মরশুমে মাথায় হাত কৃষকদের]
বারুইপুরের পেয়ারা খ্যাতি সারা পৃথিবী জুড়ে। এখানকার পেয়ারার বেশিরভাগটাই রপ্তানি নির্ভর। তাই শুধু মরশুমে নয়, সারা বছরই পেয়ারা পাওয়া যায়। বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে পেয়ারার যোগান ঠিক রাখা হয়। এখন সব পচে যাচ্ছে। ফলে তা রপ্তানি করা সম্ভব নয়। আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন এলাকার চাষিরা। শুধু তাই নয়, এলাকায় কোন হিমঘর না থাকায় ফলগুলি তৎক্ষণাৎ বাজারজাত না করলে পুরোটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা না থাকায় ফল পাকার পরেও সমস্যা হচ্ছে। লিজ নেওয়া বাগান থেকে ফল বাইরে বিক্রি করতে না পারায় পুরো টাকাই জলে চলে যাবে বলে মনে করছেন বাগান লিজে নেওয়া ব্যবসায়ীরা। ফলে লিচু, পেয়ারা, জামরুল ও গোলাপ জামুনের ব্যবসায় কয়েক কোটি টাকার লোকসান হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা।
The post লকডাউনে মাথায় হাত ফল চাষিদের, গাছেই পচছে কোটি কোটি টাকার লিচু-জামরুল-পেয়ারা appeared first on Sangbad Pratidin.