অর্ণব দাস, বারাসত: পরিচিত কোনও এক মুমুর্ষুর বিছানার কিনারে করুণ ছোঁয়া হিসেবে কমলালেবু দেখতে পেয়েছিলেন জাতকবি জীবনানন্দ দাশ। কেউ আবার কমলার কোয়ায় প্রেয়সীর ওষ্ঠস্পর্শ অনুভব করেছেন। এভাবে সৃষ্টিশীল মানুষজনের কল্পনায় নানা রূপ পেয়েছে কমলালেবু। তবে রসিক বাঙালির কাছে কমলালেবু ধরা দিয়েছেন একেবারে স্বাদের ভরপুর আধার হিসেবে। বিশেষত শীতকালে, পিকনিকের মরশুমে। বিকেলের দিকে ঢলে পড়া দুপুরের রোদ্দুর গায়ে মেখে কমলার কোয়া যেন অমৃতের স্বাদ দেয়। এই ফল আসলে পাহাড়ি এলাকার। দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি অঞ্চলে ফলনের মরশুমে কমলালেবু ভর্তি বাগান দেখলে মন ভরে যায় পর্যটকদের। এই দৃশ্য এখন দেখা যাচ্ছে উত্তরবঙ্গ ছাড়িয়ে দক্ষিণবঙ্গে সমতলের এক জেলাতেও। গাছে হাত দিলেই হাত ভরে আসছে ফলে। এমন অবিশ্বাস্য কাণ্ড ঘটিয়ে দেখিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরের নারায়ণ মণ্ডল।
গাছে হাত দিলেই হাত ভরে আসছে ফলে। অশোকনগরের বাগানে। নিজস্ব ছবি।
অশোকনগরের শ্রীকৃষ্ণপুর পঞ্চায়েতের সেনডাঙা গ্রাম। সেখানের সুধীর নার্সারির মালিক নারায়ণ মণ্ডল পাহাড়ি শীতল পরিবেশের ফলকে দক্ষিণবঙ্গের সমতলে, উষ্ণ পরিবেশে কমলালেবু ফলানোর কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সেনডাঙার কেওটসাহা গ্রামে প্রায় ৮ বিঘা জমিতে দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে নার্সারি চালান নারায়ণবাবু। বছর দুয়েক আগে ছক ভেঙে নতুন কিছু করার ইচ্ছা হয় তাঁর। সেই সূত্রেই কমলালেবু চাষের প্রতি আগ্রহ। কিন্তু কীভাবে পাহাড়ে কমলালেবু চাষ হয়, এই মিথ ভাঙবেন, তা জানতে ইউটিউব ঘাঁটতে শুরু করেন তিনি। বুঝতে পারেন, জৈব পদ্ধতিতে করলে সমতলেও কমলালেবু চাষও সম্ভব। সেই ভাবনা থেকেই গত মরশুমে দার্জিলিং, ভুটান, বাংলাদেশ, পাকিস্তান এমনকি থাইল্যান্ড থেকে ১২০টি কমলালেবুর চারা আনান তিনি।
তারপর আট বিঘার মধ্যে দশ কাঠা জমিতে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ শুরু করেন নারায়ণবাবু। গত বছর প্রথম চাষ করলেও ফলন তেমন হয়নি। কারণ জানতে আরেকটু গবেষণা করেন। বুঝতে পারেন, মাটিতে অল্প জল ধারণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেটা করেই এবছর অসাধ্য সাধন করতে পেরেছেন তিনি। তাঁর নার্সারির কমবেশি ৭০টি গাছের প্রতিটিতেই এবছর ব্যাপক ফলন হয়েছে। নার্সারিতে ঢুকলেই এখন দেখা যাবে, কমলালেবুর ভারে নুয়ে পড়েছে গাছগুলো। লেবুর আকারও বেশ, সঙ্গী সুগন্ধ। স্বাদেও টেক্কা দেবে পাহাড়কে। তাই তো চলতি শীতের সমতলে তাঁর তৈরি কমলালেবুর বাগান দেখতে প্রতিদিন দেড় থেকে দুহাজার মানুষ ভিড় করছেন সুধীর নার্সারিতে।
নারায়ণ মণ্ডলের কমলালেবু বাগান দেখতে এখন উৎসাহীদের ভিড়। নিজস্ব ছবি।
একবার হাবড়ার সুপার মার্কেটে কমলালেবু বিক্রি করতে গিয়েছিলেন নারায়ণবাবু। অনেকে দেখে তখন হতবাক হয়ে যান। পরে আর পাইকারি বাজারে বিক্রি করতে যাননি। এখন যাঁরা বাগান দেখতে আসছেন, তাঁদের হাতে ভালোবেসেই কমলালেবু তুলে দিচ্ছেন নার্সারির মালিক নারায়ণ মণ্ডল। তিনি বলেন, "সারা বছরই গাছের পরিচর্যা করি। কিন্তু ভালো ফলনের জন্য অক্টোবর, নভেম্বর মাস থেকে বাড়তি যত্ন নিতে হয়। এই সময় গাছও নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই বেশি করে সার দিতে হয়। রাসায়নিক সার দিয়ে চাষ করলে গাছ বাঁচানো মুশকিল। শুধুমাত্র জৈব পদ্ধতিতে করতে হয় চাষ। সবটাই শিখেছি ইউটিউব দেখে।"
কথায় কথায় তিনি আরও জানান, আসলে কমলালেবু চাষ তো সমতলে হয় না। তাই আকর্ষণ বেশি। এই শীতে জেলার পর্যটকদের উৎসাহের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এই কমলালেবু বাগান। এই কারণেই প্রতিদিনই মানুষের ভিড় বাড়ছে। ১ জানুয়ারি সবথেকে বেশি ভিড় হবে বলে আন্দাজ করছেন মালিক।