shono
Advertisement

ডাল বাঁকালেই বাড়তি পেয়ারা, বিপুল লক্ষ্মীলাভের সম্ভাবনা

ডাল বাঁকানোর পর যদি বৃষ্টি আসে তাহলে নতুন শাখায় বৃদ্ধি অস্বাভাবিক ঘটে।
Posted: 04:10 PM Sep 13, 2023Updated: 04:10 PM Sep 13, 2023

বর্ষাকালের পেয়ারার মান তুলনামূলক খারাপ হয়। নানারকম রোগপোকার আক্রমণের কারণে এবং খেতেও লাগে বিস্বাদ। এই সমস্যার সহজ সমাধান হিসাবে বর্তমানে পেয়ারা গাছের ডাল বাঁকানো পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় নানা জায়গায়। এই পদ্ধতি সাফল্য লাভ করে প্রশংসা অর্জন করেছে যথাযথভাবে। লিখেছেন বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক সুস্মিতা দে এবং সৌষ্ঠভ দত্ত।

Advertisement

সবুজ রঙের গোলাকৃতি দৃষ্টিবিলাসী একটি জনপ্রিয় ফল হল পেয়ারা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বর্তমানে সারা বছরই এই ফলের চাষ হয়ে থাকে। নানারকম স্বাস্থ্যকর গুণাবলীর উপস্থিতির কারণে এবং তুলনামূলক সহজসাধ্য হওয়ায় এই ফল হয়ে উঠেছে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছে সহজলভ্য। তাই ফলটি ‘গরিবের আপেল’ নামেও সুপরিচিত। পেয়ারা একটি দ্রুত বর্ধনশীল গ্রীষ্মকালীন ফল। দেশের সর্বত্রই কম বেশি এই ফলের চাষ হয়ে থাকে। দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলা যেমন মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর এবং হাওড়াতে বাণিজ্যিকভাবে এর চাষ হয়ে থাকে। পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু পরিস্থিতিতে সারা বছরেই এই ফলের চাষ হলেও, সমস্ত ফলের গুণগত মান সমান হয় না বিভিন্ন কারণে।
পুষ্টি ও গুণাগুণ
পেয়ারা ভিটামিন ‘সি’ সমৃদ্ধ একটি ফল। করোনাকালে মানুষের স্বাস্থ্যোন্নতির জন্য প্রায়শই চিকিৎসকরা ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ভিটামিন সি-এর উৎস হিসেবে যে সমস্ত ফল বাজারে সহজলভ্য, তাদের মধ্যে পেয়ারা হল অন্যতম। পেয়ারা একদিকে যেমন দেহের ইমিউনিটি পাওয়ার বাড়াতে সাহায্য করে। অন্যদিকে দাঁত মজবুত রাখতেও অন্যতম ভূমিকা নেয়। এছাড়া পেয়ারাতে প্রচুর পরিমাণ ভিটামিন-বি ও প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ যেমন- ক্যালসিয়াম ও আয়রন পাওয়া যায়। পেয়ারা কাঁচা ও পাকা উভয় অবস্থায় খাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য ফলে ১৪.৫% শ্বেতসার, ১.৫% প্রোটিন, ১.০% লৌহ, ০.০১% ক্যালসিয়াস, ৩০.০ মিলি গ্রাম ভিটামিন বি-১, ৩০.০ মিলিগ্রাম রিবোফ্লোভিন, ২৯৯.০ মিলীগ্রাম ভিটামিন-সি এবং ৬৬ ক্যালরি রয়েছে। ফলে যথেষ্ট পরিমাণে পেকটিন থাকায় সহজেই জ্যাম, জেলি, চাটনি ইত্যাদি মুখরোচক খাবার তৈরি করা যায়।

[আরও পড়ুন: স্ত্রী ও মেয়েকে খুন করে থানায় আত্মসমর্পণ স্বামীর! কারণ নিয়ে ঘনাচ্ছে রহস্য]

পেয়ারার উল্লেখযোগ্য জাত
আমাদের পশ্চিমবঙ্গে পেয়ারার যে সব জাত ব্যাবসায়িক ভিত্তিতে চাষ করা হয় সেগুলি হল, এল-৪৯, এলাহাবাদ সফেদা, বারুইপুর ও খাজা পেয়ারা। এইসব জাতগুলির মধ্যে ‘বারুইপুর লোকাল’ ব্যাপক হারে চাষ হচ্ছে। এই জাতের ফলের আকার যেমন বড়, দেখতে সুন্দর ও ফলের মধ্যে বীজ কম থাকে। লোকাল ট্রেনে এই জাতটির ফল অহরহ বিক্রি হতে দেখা যায় এবং ক্রেতাদের মধ্যেও কেনার ঝোঁক প্রবল। এই গুরুত্বপূর্ণ পেয়ারার জাতটিতে ডাল বাঁকানো পদ্ধতি বিপুল হারে প্রয়োগ করে অধিক পরিমাণে সুস্বাদু ফল পাওয়া যাচ্ছে।
ডাল বাঁকানো পদ্ধতি কী?
পেয়ারার ফুল নতুন শাখায় আসে। অসময়ে বেশি ফুল-ফল পেতে গাছের লম্বা ডাল বেঁকিয়ে অন্য ডালের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয় কিংবা ডালের ডগায় ওজন ঝুলিয়ে বাঁকানো হয়। ফলে কিছুদিনের মধ্যে ডালের বাঁকানো অংশের কাছ থেকে নতুন প্রশাখা বেরিয়ে, সেখান থেকে ফুল-ফল ধরতে থাকে।
ডাল বাঁকানো পদ্ধতির বিভিন্ন ধাপ
● কমপক্ষে ৫×৫ মিটার দূরত্বে বসানো পেয়ারা বাগানে তিন থেকে আট বছর বয়সী গাছ গুলিতে ডাল বাঁকানো পদ্ধতি অবলম্বন করা যেতে পারে।
● ডাল বাঁকানোর ১৫-২০ দিন আগে, প্রতিটি গাছের বাৎসরিক প্রয়োজনীয় সারের অর্ধেক পরিমাণ সার প্রয়োগ করে দিতে হবে।
● ডাল বাঁকানোর সময় ডালের ডগার ১২-১৪ জোড়া পাতা রেখে বাকি সব পাতা ফুল ও ফল ঝরিয়ে ফেলতে হবে।
● এরপর গাছের চারদিকের সমস্ত ডালগুলি গোড়ার দিক থেকে আগার দিকে বেঁকিয়ে, ডালের ডগার অংশ দড়ি দিয়ে মাটিতে পোলের সঙ্গে বেঁধে দিতে হবে। এইভাবে গাছের সমস্ত অংশ বেঁকিয়ে মাঝের অংশকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
● এরপর যখন বাঁকানো ডাল গুলি থেকে নতুন প্রশাখা বেরোতে শুরু করে, তখন ওই পোল থেকে সাবধানে দড়ি খুলে ডাল গুলিকে পুনরাবস্থায় নিয়ে যেতে হবে।
● নতুন প্রশাখায় আসা ফুল থেকে মার্বেল আকৃতির ফল ধরলে বাকি পরিমাণ সার গাছে প্রয়োগ
করতে হবে।
ডাল বাঁকানো পদ্ধতির সুবিধা
● নির্দিষ্ট সময়ে গুণগত মানসম্পন্ন ফল পাওয়া যায়।
● অধিক ফলন পাওয়া সম্ভব।
● এই পদ্ধতি তুলনামূলক সহজ এবং কম খরচে হয়।
● একই মাপের ফল পাওয়া সম্ভব।
● রোগ পোকার আক্রমণ কম হয়।
ডাল বাঁকানোর সময়
বছরের যেকোনও সময়ে ডাল বাঁকানো গেলেও পেয়ারা গাছের ফুল ফল ধরার নিরিখে সাধারণত দুটি সময়ে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করার প্রক্রিয়া ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মকালে চৈত্র-বৈশাখ মাসে ডাল বাঁকালে ৮-১০ দিন পর নতুন প্রশাখা দেখা দেয় এবং ৪৫ দিন পর ফুল আসে। আশ্বিন কার্তিক মাসে ডাল বাঁকালে ২০-২৫ দিন পর নতুন প্রশাখা আসে এবং ৬০-৬৫ দিন পর ফুল আসে। এছাড়া হেমন্তকালে ডাল বাঁকালে ১৫-২০ দিন পর নতুন প্রশাখা আসে এবং ৪৫-৬০ দিন পরে নতুন ফল আসে।
অতিরিক্ত আয়ের দিশা
যেহেতু মূল ফসলটি ৫×৫ মিটার দূরত্বে লাগানো, তাই মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গা অপচয় না করে সেখানে সাথী ফসল হিসাবে আদা, হলুদ কিংবা যেকোনও মরশুমী সবজি গাছ চাষ করে চাষিভাইরা একই জমি থেকে অতিরিক্ত আয়ের সন্ধান পেতে পারেন। এক্ষেত্রে পেয়ারা গাছের বয়স ৫ বছর হওয়া পর্যন্ত এই সাথী ফসল চাষ করা যেতে পারে এবং নিঃসন্দেহে কৃষকরা এতে উপকৃত হবেন।
ডাল বাঁকানো পদ্ধতি অবলম্বন করে চিরাচরিত পদ্ধতির তুলনায় ফলন বৃদ্ধি
এই পদ্ধতিতে পেয়ারা গাছে সারা বছরই অর্থাৎ অসময়ে ফল ধরে। অসময়ে ফল ধরার কারণে ফলের বাজারমূল্যও বেশি পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং এতে অনেক কম খরচে কোনওরকম ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার না করেই বেশি ফলন পাওয়া যায়। এই পদ্ধতির প্রয়োগে প্রতিটি পেয়ারা গাছ থেকে সাধারণ পদ্ধতিতে চাষের তুলনায় কম করে হলেও ৮-১০ গুণ বেশি পেয়ারা উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে। গাছের বয়স ২ বছর হওয়ার পরেই এই পদ্ধতি অনুসরণ করা যাবে এবং ৮ বছর বয়স পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে এর প্রয়োগ করে অধিক ফলন লাভ করা যাবে। একটি ৩-৪ বছরের পেয়ারা গাছে ডাল বাঁকানো পদ্ধতিতে গড়ে ৩০-৪০ কেজি পেয়ারা পাওয়া সম্ভব।

কোনও কৃষক তার ১ হেক্টর জমিতে (৫×৫ মিটার দূরত্বে বসানো) ৪০০টি পেয়ারা গাছ লাগালে, এই পদ্ধতি অবলম্বন করে রাসায়নিক সার, জৈব সার এবং অনুখাদ্য ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে আনুমানিক ৭০-৮০ হাজার টাকা খরচ করলে প্রায় ১৪০-১৫০ কুইন্টাল ফলন পেতে পারবেন এবং বাজারে যদি ৩০ টাকা প্রতি কেজিতে ফল বিক্রি করেন তবে ১ বছরে প্রায় ৪.৫-৫ লক্ষ টাকা আয় করতে সক্ষম হবেন। খরচের সাপেক্ষে এই বিপুল পরিমাণ প্রাপ্য লাভ দেখে অনেক চাষিভাইরা উৎসুক হবেন এই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিটিকে পেয়ারা গাছে প্রয়োগ করার লক্ষে এবং নিশ্চিত ভাবে তারা সফলতা পাবেন এই আশা করাই যায়।

লক্ষ‌ করা গিয়েছে যে ডাল বাঁকানোর পর যদি বৃষ্টি আসে তাহলে নতুন শাখায় বৃদ্ধি অস্বাভাবিক ঘটে এবং ওই শাখায় ফুল আসে না। অর্থাৎ ডাল বাঁকানোর ৩-৪ সপ্তাহ অবধি বৃষ্টি বা আর্দ্র আবহাওয়া ফুল আসার পক্ষে ক্ষতিকারক। এইভাবে গ্রীষ্মকালে (মে-জুন মাস) ডাল বাঁকানো হলে ফল পাকতে শুরু করবে অক্টোবর-জানুয়ারি মাসের মধ্যে। উন্নত জাতের কলমের চারা সঠিক দূরত্বে লাগালে, ঠিকমতো প্রশিক্ষণ, সার প্রয়োগ, পরিচর্যা করলে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে সারা বছর ফল পাওয়া সম্ভব। কৃষকবন্ধুদের সঠিক পথ দেখাতে পারলে সহজেই সারাবছর এই ফলের চাষ করা যাবে অচিরেই এবং কৃষি জগতে দেখানো যাবে নতুন দিশা।

[আরও পড়ুন: রাজ্যজুড়ে শুক্রবার পর্যন্ত চলবে বৃষ্টি, সপ্তাহান্তে বদলাতে পারে হাওয়া, কমবে তাপমাত্রা?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement