সৃঞ্জয় বোস, মস্কো: উনিশের তারুণ্যদীপ্তির সঙ্গে চল্লিশের অভিজ্ঞতা মিশিয়ে দিন। গোলের পর দু’হাত জড়ো করে শিশু-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে জুড়ে দিন আন্দ্রে ইনিয়েস্তার স্কোয়ার-ইঞ্চি মাপা পরিণত ফাইনাল পাস। ছেলেটার হরিণ-গতি, মায়াবী ড্রিবল, যৌবনের উদ্ধত শরীরী ভাষা দেখতে দেখতে গুগল সার্চ করুন। চলে যান ছেলেটার শৈশবে। যেখানে প্রবল ছটফটে, অসম্ভব দুষ্টু এক শিশু ঘাম ছুটিয়ে দিচ্ছে স্কুল টিচারদের। ফুটবলার মা-কে দিনের পর দিন উপহার দিচ্ছে নির্ঘুম রাত।
[সম্মানের লড়াইয়েও ব্যর্থ ব্রিটিশরা, ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে তৃতীয় বেলজিয়াম]
কিলিয়ান এমবাপের কথা বলছি। ফ্রান্সকে ইউরোপের রানি বলে। ফ্রান্স রানি হলে, জাতীয় ফুটবল টিমের রাজা উনিশ বছরের এমবাপে। বিশ্বকাপ শুরুর সময় ফরাসি টিমের প্রচুর নাম শুনেছিলাম। আঁতোঁয়া গ্রিজম্যান। দ্য ব্যান্ডমাস্টার। অলিভিয়ের জিরু। দ্য পারফেক্ট স্ট্রাইকার। এমবাপেও শুনেছিলাম। কিন্তু ফরাসি ফরোয়ার্ড যে রাশিয়া বিশ্বকাপে নেমে পেলে, রোনাল্ডোদের তাড়া করতে শুরু করবেন, বুঝিনি। ভাবিনি, সোনার বলের দৌড়ের স্প্রিন্ট এ ভাবে টানতে শুরু করে দেবেন।
রবিবাসরীয় লুঝনিকি ফাইনালের আগে এমবাপে নিয়ে লেখার কারণ, কাপ ফাইনালে তিনিই সর্বজনগ্রাহ্য ফরাসি এক্স ফ্যাক্টর। তাঁর গতি, তাঁর ড্রিবলিং.. সব। উনিশশো আটান্নর পেলে ছাড়া আর কোনও ফুটবল-গ্রেটের কথা মনে পড়ে না যিনি এত কম বয়সে বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলবেন, বিশ্বজয়ের স্বপ্ন-দরজার দোরগোড়ার সামনে দাঁড়িয়ে পড়বেন। পেলে বিশ্বজয়ী হয়েছিলেন সতেরো বছর বয়সে। ব্রাজিলের রোনাল্ডো সতেরো বছর বয়সে ’৯৪-এর বিশ্বজয়ী ব্রাজিল স্কোয়াডে ছিলেন। কিন্তু কোনও ম্যাচে খেলেননি। এমবাপে সেখানে শুধু খেলবেন না। দিদিয়ের দেশঁর ফ্রান্সের ব্রহ্মাস্ত্র হিসেবেই তাঁর লুঝনিকি অবতরণ ঘটবে। প্রাক ফাইনাল ফরাসি কাগজ ঘেঁটে দেখলাম, আটানব্বইয়ের বিশ্বজয়ী ফরাসি ফুটবলার ইউরি জোরকোয়েফ এমবাপেকে সেরার শিরোপা ইতিমধ্যে দিয়ে দিয়েছেন! তিন বিশ্বশ্রেষ্ঠ ফুটবলারকে হঠিয়ে। “মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার কী করছে না করছে, সব ইতিহাস।
এমবাপে ওদের ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে। মেসি, রোনাল্ডো পুরনো । এমবাপেই এরপর বিশ্বসেরা হবে,” বলে দিয়েছেন জোরকোয়েফ। জোরকোয়েফের স্পর্ধা অবাক করে। কিন্তু খুব ভুল বলেছেন কি? বিশ্বকাপ ফুটবলারের কাছে নিজেকে চেনানোর শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। মেসি, রোনাল্ডো, নেইমাররা সেখানে আর কী করেছেন? ফরাসি মিডিয়ার কেউ কেউ আবার এ দিন এমবাপের শৈশবের পাড়ায় গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে তারা প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে কিছু বিস্ময়-মুক্তো তুলে এনেছেন। বন্ডির ক্যাথলিক স্কুলে পড়তেন শিশু এমবাপে। এতটাই দুরন্ত ছিলেন যে, তাঁর মা শিশু কিলিয়ানের প্যান্টে দাগ দিয়ে রাখতেন। পাছে ছেলে কোথাও চলে যায়! স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের বলে রাখতেন, কিলিয়ানকে চোখে চোখে রাখতে। এরপর নিশ্চয়ই উনিশের এমবাপের স্রেফ ছুটিয়ে বিপক্ষ ডিফেন্স ছারখার করার দৃশ্য অবাক লাগে না? যে ছেলেকে গর্ভধারিনী মা, শিক্ষক-শিক্ষিকারা মার্কিং করতে পারেননি, সেখানে আন্তর্জাতিক ডিফেন্ডার কোন ছার!
[OMG! ফাইনালের আগে নেটদুনিয়ায় ফের উষ্ণতা ছড়ালেন ক্রোট প্রেসিডেন্ট!]
এমনিতে ফ্রান্স বনাম ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ-যুদ্ধের স্বতন্ত্র একটা ইতিহাস আছে। ফ্রান্স যে বছর প্রথমবার বিশ্বজয়ী হয়েছিল, সেই আটানব্বই বিশ্বকাপে ক্রোয়েশিয়াকেই সেমিফাইনালে ২-১ হারিয়ে ফাইনালে ওঠেন জিনেদিন জিদানরা।চ্যাম্পিয়নও হন। যার পর বিখ্যাত ডকুমেন্টারি তৈরি হয় ফরাসি ফুটবলের উপর। নাম-আইস ইন দ্য ব্লু’জ। যেখানে খুঁজলে পাওয়া যায় ক্রোটদের বিরুদ্ধে সেমি-যুদ্ধ হাফটাইম পর্যন্ত গোলশূন্য থাকার পর প্লেয়ারদের কী বলেছিলেন তৎকালীন ফরাসি কোচ এইমে জাঁক। বলেছিলেন যে, আমরা নিজেরাই নিজেদের নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছি। দেখো, তোমরা হয় রিঅ্যাক্ট করো। ভাবো, শেষে ফাইনাল অপেক্ষা করছে। নইলে হাল ছেড়ে দাও। আমি বুঝতে পারছি না, তোমরা ভয়টা পাচ্ছ কীসের? লিখে নাও, চেষ্টা করলে তোমরা ওদের হারিয়ে ফিরবে। ফিরবেই। এইমে জাঁকের পেপ-টকে যারপর প্রবল কাজও হয়েছিল। ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সই বার করেছিল। কুড়ি বছর পর দিদিয়ের দেশঁ নিশ্চয়ই একসময়ের ‘গুরু’ এইমে জাঁকের মন্ত্র ধার করতে চাইবেন। রবিবার নামার আগে এমবাপের কানে-কানে ওরকমই কিছু বলবেন নিশ্চয়ই। যাতে মাঠে নেমে মূর্চ্ছনা সৃষ্টিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ফরাসি ‘বিঠোভেন’। কিন্তু সেই একই কাহিনি, ফরাসিদের হাতে ক্রোটদের চিরকালীন দুঃখের কাহিনি কি ‘বলকান মোৎজার্ট’-কেও শোনাবেন না দালিচ? এমবাপে-রোধে তাঁর সেরা প্রাচীরকে? কে ইনি?
বত্রিশ বছরের বুড়োটে মুখে উনিশের তারুণ্যজেদ বসিয়ে দিন। সঙ্গে জুড়ে দিন জাভির ভিশন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ওয়ার্করেট। যথেষ্ট। ইন্টারনেট, গুগল সার্চ এসব কিছুই আর লাগবে না। বরং লাল সাদা চেক জার্সিতে এক অবয়ব আপনাআপনি হাজির হয়ে যাবে। বিশ্বজয়ের ক্ষুধায় যাঁর চোখ ধকধক করছে। লুকা মদ্রিচকে এরপর অনায়াসে চেনা যায়। লুঝনিকি ফাইনালে এমবাপে ফরাসি ‘বিঠোভেন’ হলে যিনি ‘বলকান মোৎজার্ট!’ এমবাপে ১৯ বছরের নবীন হলে তিনি ৩২ বছরের প্রবীণ। কিন্তু তাতে কী? পড়লাম, ফাইনালে নাকি ফরাসি জনতার কাছে দুশ্চিন্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ প্র্যাকটিস সেশনের এক ভিডিও। যেখানে বল নিয়ে নানা অদ্ভুতুড়ে অ্যাক্রোব্যাটিকস করে যাচ্ছেন মদ্রিচ। আর শেষে প্রাক্তন রিয়াল কোচ জিনেদিন জিদান বলছেন, “লুকার আরও বেশি করে গোলে শট মারা উচিত। দারুণ শ্যুট করে ও।” ফরাসি জনতা দুশ্চিন্তা করছে, মদ্রিচ যদি ফরাসি কিংবদন্তির মন্ত্র ফাইনালেই অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে শুরু করেন, দুঃখ আছে।
ক্রোট অধিনায়ক বল পায়ে কী করতে পারেন, জানে বিশ্বকাপ। জানে, তাঁর গেম রিডিং মারাত্মক। পাসগুলো লেসার-নিয়ন্ত্রিত। নিঃসন্দেহে যিনি ফাইনালে ফ্রান্সের সেরা বাধা। এমবাপেকে থামানো এবং টিমের খেলা ছড়ানো- দুইয়েরই দায়িত্ব মদ্রিচের কাঁধে থাকবে। ‘ব্লু’ ডিফেন্ডার স্যামুয়েল উমতিতি সে দিন দেখলাম বলে ফেলেছেন, “মদ্রিচই আসল। ক্রোয়েশিয়ার পুরো খেলাটা ওকে মাঝখানে রেখে ঘোরে।” ক্রোয়েশিয়ার কাগজে সে দেশের প্রাক্তন তারকা মারিও স্টানিচ আবার বলেছেন, “মদ্রিচ ফুটবল খেলেন না। ফুটবলের পুজো করেন!”
শুধু পূজারি নন। নমস্য পূজারি মদ্রিচ। ফুটবল-বিশেষজ্ঞদের সবচেয়ে বেশি টানছে, ১১৫ মিনিট ধরে মদ্রিচের বল পজেশন ধরে রাখার জেদ। টানছে, বত্রিশেও তাঁর ক্লান্তিহীন পরিশ্রম। সতীর্থদের জন্য ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক ফেলে না রাখা। স্টানিচের কাছে একনিষ্ঠ ফুটবল-পূজারি হলেও দেশ তাঁকে বড় একটা পুজো করে না। বরং মদ্রিচ বিতর্ক-বিদ্ধ চরিত্র, যাঁর বিরুদ্ধে দেশে মামলা চলছে। কিন্তু তাতে কী? জীবনের বিভিন্ন মোড়ে পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ে যাওয়া তো তাঁর কাছে নতুন নয়। ছ’বছর বয়স থেকে লড়ছেন। যুগোস্লাভিয়া ভাগের যুদ্ধের সময় যখন গ্রাম থেকে পালাতে হয়েছিল। দাদুর মৃত্যু যখন দেখতে হয়েছিল চোখের সামনে। শরণার্থী শিবিরে যখন কাটাতে হয়েছিল দিনের পর দিন। তারপরেও ফুটবলের ‘বলকান মোৎজার্ট’ অমর সুর সৃষ্টি করেছে, করছে, কে জানে হয়তো বা রবিবারেও করবে। চোখে সম্ভবত শেষ বিশ্বকাপে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে। করুক না, ক্ষতি কী? মোৎজার্ট না বিঠোভেন-কে সেরা তা নিয়ে আজও তর্ক চলে। রবিবাসরীয় লুঝনিকি সে দিক থেকে ভাগ্যবান। সে অন্তত ফুটবলের বিঠোভেন বনাম মোৎজার্টের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি দেখবে!
[কার হাতে উঠবে বিশ্বকাপ, কী চাইছেন টলি সুন্দরীরা?
The post বিশ্বকাপের ফাইনালে ফরাসি বিঠোভেন বনাম বলকান মোৎজার্টের লড়াই appeared first on Sangbad Pratidin.