অনির্বাণ চৌধুরী: কত যেন বয়স হল করণ জোহরের?
পাক্কা ৪২ বছর। এই ৪২ বছরে রুপোলি পর্দায় অনবরত সম্পর্কের গল্প বুনলেন তিনি। সেই গল্প বলার মুন্সিয়ানাটি তুঙ্গরেখা ছুঁল ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’-এ এসে।
‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ নিপাট এক সম্পর্কের গল্প। সম্পর্কই এই ছবির তুরুপের তাস। এছাড়া আর কিছুই নেই। শুধুমাত্র সেটুকু সম্বল করেই করণ জোহর বুঝিয়ে দিলেন, বলিউডে তাঁর চেয়ে ভাল সম্পর্কের গল্প আর কেউ বলতে পারে না!
তবে, খুব সহজে এই মুন্সিয়ানা করণ জোহরের আয়ত্তে আসেনি। সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে যেমন আমরা সেটাকে পুরোপুরি বুঝতে পারি, করণ জোহরের সঙ্গেও সেটাই হয়েছে। ২৬ বছরে পা দিয়ে ১৯৯৮ সালে তিনি বানালেন তাঁর প্রথম ছবি- ‘কুছ কুছ হোতা হ্যায়’। অচরিতার্থ প্রেম পূর্ণতা পেল সেই গল্পে। এর পর ২৯ বছর বয়সে ২০০১-এ ‘কভি খুশি কভি গম’। সেখানেও কিন্তু সম্পর্ক রইল- পারিবারিক ইগো ক্ল্যাশ হয়ে যা ধরা দিল পর্দায়।
৩১ বছর বয়সটা করণ জোহরের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৩-এ তিনি কোনও ছবি পরিচালনা করলেন না, স্রেফ প্রযোজনা করেই ক্ষান্ত রইলেন। নিখিল আদবানির ‘কাল হো না হো’। আজ ২০১৬-য়, করণ জোহরের যখন ৪২ বছর, তখন একটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিল- ওই ছবিটা নিখিল আদবানি বানিয়েছিলেন তো? না কি ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’এ প্রভাব পড়ল ‘কাল হো না হো’র? প্রশ্নটা আসবেই, কেন না সেই ছবির চিত্রনাট্য জুড়ে রয়েছে নায়িকার অচরিতার্থ প্রেম। যা বদলে যাচ্ছে বন্ধুত্বের দিকে। ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’এও তো তাই!
অতঃপর ৩৪ বছর বয়সে, ২০০৬ সালে আমরা করণ জোহরের কাছ থেকে পেলাম ‘কভি অলবিদা না কহেনা’। সেখানেও ভালবাসা ভাঙল এবং ফের তা অন্যের মধ্যে খুঁজে পেল পরিপূর্ণতা। এবং হিসেব কষতে গিয়ে আমরা টের পেলাম, আরও ৮টি বছর পেরিয়ে এসে ৪২ বছরে, ২০১৬-য় অনেক পরিণত হয়ে উঠেছেন করণ জোহর। অন্য অনেকের মতোই তিনিও হয়তো বা বিশ্বাস করেন- কিছু কিছু সম্পর্ক পরিণতি না পাওয়াই ভাল!
এই সম্পর্ক ভাঙা, মন ভাঙা, প্রাক্তনটিকে কিছুতেই ভুলতে না পারা, অন্যের প্রেমে পড়ে পাশ কাটানোর চেষ্টা- এই সব কিছুর মধ্যে দিয়ে শেষ পর্যন্ত অচরিতার্থ প্রেমের কথাই রুপোলি পর্দায় বলে গেল ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’। আয়ান (রণবীর কাপুর) এক ডিস্কোথেকে প্রথম দেখল আলিজেকে (অনুষ্কা শর্মা)। কিন্তু, আলিজে আজও ভুলতে পারেনি প্রথম প্রেম আলিকে (ফওয়াদ খান)। শেষ পর্যন্ত সে তাই ফিরে গেল আলির কাছেই। ভাঙা মন নিয়ে আয়ান খুঁজে পেল সাবা তলিয়ার খানকে (ঐশ্বর্য রাই বচ্চন)। কিন্তু, সেই সম্পর্কও ভাঙল!
বড্ড জটিল মনে হচ্ছে কি গল্পের গঠনটা? সম্পর্ক জিনিসটাই তো তাই! কবেই বা আর সে সোজা পথে হেঁটেছে! ফলে করণ জোহর একেকটি ফ্রেম পেরিয়ে পেরিয়ে ক্রমাগত জটিলতর করে তুলতে থাকেন ছবির চিত্রনাট্য। কোনও প্রেমকেই ছোট করেন না, কোনও বিশেষ সম্পর্ককে আবার মহানও করে তোলেন না! যেমন, আলিজের কাছ থেকে আয়ান পায় কষ্ট যা তাকে পরিণত করে। অন্য দিকে, সাবা তাকে দেয় নিজের কবিতা যা পরে গান হয়ে মজবুত করে তোলে আয়ানের ভিত। কোনওটাই ফেলনা নয়!
কিন্তু এত কিছুর পরেও করণ জোহর হিসেব মিলিয়ে দেন না। আমরা বুঝতে পারি, দুইয়ে দুইয়ে চারের খেলা তাঁকে হয়তো বা ক্লান্ত করে তুলেছে। তাই যখনই মনে হয় সম্পর্ক জুড়তে চলেছে, অপ্রত্যাশিত কোনও ঘটনায় সেই আশায় জল ঢেলে দেন তিনি। সত্যি বলতে সম্পর্ক কি ঠিক তেমনটাই নয়? প্রতি মুহূর্তেই তো আমাদের মনে হয়, এই বুঝি ভালবাসা ধরা দিল, কিন্তু সব সময় কি আর হিসেব মেলে?
এই সম্পর্কের গল্পই নিঃসন্দেহে এবারের দিওয়ালিতে প্রেক্ষাগৃহ মাতাবে। নিরঞ্জন আয়েঙ্গারের সঙ্গে মিলে করণ জোহর চিত্রনাট্যটি তেমন জোরদার করেই তৈরি করেছেন। এই ছবি আদতে যেমন অনায়াস, তেমনই কাব্যিকও। প্রায় প্রতি সংলাপেই ঢুকেছে উর্দু শব্দ। যা চরিত্রগুলোকে খুব স্পষ্ট করে তুলেছে। পাশাপাশি এমন এক আবহ এনেছে যা বলিউডের ছবিতে বেশ দুর্লভ।
এই সম্পর্কের খেলাকেই প্রায়ান্ধকার এক সিনেম্যাটোগ্রাফিতে বেঁধেছেন অনিল মেহতা। যা খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছে নাগরিক জীবনের কথা। করণ জোহরের এই ছবি ভীষণ ভাবেই নাগরিক। শহরজীবনের সবটুকু নিয়েই সম্পর্কের শেষ কথা।
সেই শহরজীবন আর সম্পর্কের বৃত্তে দাঁড়িয়ে পরিণতির ক্রমটুকু দুর্দান্ত ভাবে তাঁর অভিনয়ে ধরেছেন রণবীর কাপুর। প্রথম যখন আয়ানকে আমরা ছবিতে দেখি, তখন সে নিতান্তই এক ব্যথা-খাওয়া ছেলে। প্রেম কী, তখনও সে তা বোঝেনি। ফলে বার বার কেঁদে ফেলে। আয়ানের চোখের জলকে বেশ কয়েকবার ছবিতে চরিত্রটির পরিণত হওয়ার সূত্রে ব্যবহার করেছেন পরিচালক। আর প্রতিবারেই সফল হয়েছেন রণবীর। একবারের জন্যও তিনি বুঝতে দেননি, ওই চোখের জল মেকি! আয়ানের ছেলেমানুষি, আয়ানের জেদ, আয়ানের রাগ, আয়ানের প্রাপ্তমনস্কতা- চেহারাটাই শুধু রণবীরের! এত ভাল কাজ রণবীর এর আগে করেছেন কি না সন্দেহ!
মজা হল, সব অভিনেতাদেরই সেরা কাজটা ছবিতে তুলে এনেছেন করণ জোহর। স্বতস্ফূর্ততা আর একরোখা মন নিয়ে আলিজেও একেবারে যথাযথ। অনুষ্কা শর্মাকে শুরু থেকেই খুব স্বতস্ফূর্ত চরিত্রে কাস্ট করেছে বলিউড। করণ জোহরও সেটাই করলেন। কিন্তু, পদে পদে রাখলেন কিছু মোচড়! সেই মোচড় এক পরিণত অভিনেত্রীই কেবল সামলাতে পারেন। অনুষ্কা শুধু সামলিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, দর্শকের সেলাম আদায় করে ছেড়েছেন।
তবে, স্ক্রিন প্রেজেন্সের কথা ধরলে ছবিতে সবাইকে টেক্কা দিয়েছেন ঐশ্বর্য রাই বচ্চন। করণ জোহর একবার এক অনুষ্ঠানে মজাচ্ছলে জানিয়েছিলেন সলমন খানকে- তিনি নায়িকা হতে পারলে ঐশ্বর্য রাই বচ্চন হতে চাইতেন! ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ দেখে ফের মনে পড়ল কথাটা! বোঝা গেল, করণ জোহর কতটা গভীর ভাবে সাবা তলিয়ার খানকে গড়েছেন। সেই মেয়ে স্বামীকে ডিভোর্স দেয়, হাঁটুর বয়সী ছেলের প্রেমে পড়ে, আবার দরকারের সময় তাকে ছেড়ে দেয় পথে। তার পথের কাঁটা হয়ে থেকে যায় না। সৌন্দর্য আর বুদ্ধিমত্তার আবেদনে ঐশ্বর্য ছাড়া চরিত্রটিতে আর কাউকে কল্পনাই করা যাচ্ছে না। বলাই যায়, ঐশ্বর্য না থাকলে এই ছবি এতটাও প্রাণবন্ত হত না! তবে হ্যাঁ, সেন্ট্রাল বোর্ড অফ ফিল্ম সার্টিফিকেশনের হাতে পড়ে ঐশ্বর্য-রণবীরের যৌনদৃশ্য কাঁচি হলেও তাতে ছবির কোনও ক্ষতি হয়নি।
আর, ফওয়াদ খান? ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ দেখলে তাঁর জন্য যে কারও খারাপ লাগবে। খারাপ লাগবে এই ভেবে যে তিনি আর বলিউডে কাজ করবেন না। রাজনীতির চাপে পড়ে ফওয়াদ খানের চরিত্রটিকে করণ জোহর প্রায় ক্যামিওর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছেন। কিন্তু, যতটুকু দেখা গিয়েছে ফওয়াদকে, বোঝা গিয়েছে, তিনি রণবীরকেও টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা ধরেন!
আর ভাল লাগবে বড়জোর মিনিট দুয়েকের আবির্ভাবে সাবার স্বামীর ভূমিকায় শাহরুখ খানকে। তবে ভাল লাগলেও চরিত্রটির প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।
ও হ্যাঁ, অনেকে এই ছবির মধ্যে ইমতিয়াজ আলির ‘রকস্টার’ ছবির একটা আলগা সাদৃশ্য পেলেও পেতে পারেন! কী যায় আসে! একজনের জীবনের সম্পর্কও কি মাঝে মাঝে অন্যের সঙ্গে মিলে যায় না?
ছবি: অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল
পরিচালনা ও প্রযোজনা: করণ জোহর
চিত্রনাট্য: করণ জোহর, নিরঞ্জন আয়েঙ্গার
সিনেম্যাটোগ্রাফি: অনিল মেহতা
অভিনয়: ঐশ্বর্য রাই বচ্চন, রণবীর কাপুর, অনুষ্কা শর্মা, ফওয়াদ খান
৩.৫/৫
The post প্রত্যেকের সম্পর্কের গল্প বলছে ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ appeared first on Sangbad Pratidin.