শম্পালী মৌলিক: সাহিত্যের আধারে ছবি করার ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। প্রথমত, রেডি টেক্সট পাওয়া যায়। দ্বিতীয়ত, সেই টেক্সটকে সার্থক চিত্ররূপ দেওয়া চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। পরিচালক রাজ চক্রবর্তী সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন ‘বাবলি’ (Babli) ছবিতে। বুদ্ধদেব গুহর জনপ্রিয় উপন্যাস ‘বাবলি’ লেখা হয়েছিল আটের দশকে মধ্যভাগে। সেই কাহিনি অবলম্বনে এই ফিল্ম, এতদিনে সকলেই জানেন। ‘পরিণীতা’র পর আবার রাজ প্রেমের ছবিতে হাত দিলেন। এক্ষেত্রে তাঁর তুরুপের তাস আবির চট্টোপাধ্যায়- শুভশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো ফ্রেশ জুটি। এবং অবশ্যই ছবির তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সৌরসেনী মৈত্র।
ব্যক্তিগত ভাবে ‘বাবলি’ আমার খুব প্রিয় উপন্যাসের তালিকায় পড়ে না। ছবিটা দেখতে গিয়ে বই পড়ার অনুভূতি না হলেও, ভালই লাগে। একটু অবাকই হয়েছি এমন অশান্ত সময়ে মাল্টিপ্লেক্সে প্রায় পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ দেখে, তাও আবারও বাংলা ছবির জন্য! হতে পারে সপ্তাহান্ত বলে। এ ছবির সময়কাল ১৯৯৫ সাল। বইটা যাদের পড়া তাদের গল্পটা জানাই। তবু উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরবঙ্গের প্রকৃতির টানে বড়পর্দায় ছবিটা দেখতে ভাল লাগবে। আর সর্বোপরি প্রেমের গল্পের টান এখনও মরেনি বলেই বিশ্বাস করি। গোয়েন্দা চরিত্রের বাইরে গিয়ে প্রেমিক আবির ‘অভিরূপ সেন’-এর চরিত্রে টি-টোয়েন্টির মতো ঝোড়ো ব্যাটিং করেছেন। তাঁর চেহারার চুম্বক আকর্ষণ অনস্বীকার্য। একরাতের আকস্মিক ঘটনা, একসঙ্গে থাকা, দুটো মানুষকে কাছাকাছি এনে দেয়। ওই রাতটাই তাদের পরবর্তী জীবনের দিক নির্দেশ করে। প্যাশনেট প্রেমের গল্প বাস্তবোচিত করে তুলতে আবির-শুভশ্রী জুটির রসায়ন কার্যকরি হয়েছে। বাবলি সরাসরি কথা বলে, কিছুটা আউট স্পোকেন বলা চলে। শিক্ষিত-স্মার্ট তবে প্রেমের ক্ষেত্রে খুব পজেসিভ, অভিমানীও বটে। ঈষৎ স্থূল চেহারা নিয়ে তার ভিতরে কমপ্লেক্স কাজ করে অবিরত। এমন সময় অভিরূপ এসে বলে দেয়- ‘আপনি সেরকম মোটা নন। আর দেখতেও বেশ ভাল।’ অতএব আর উপায় কী! সুপুরুষ, মিতভাষী, বিনয়ী অভি-র চরিত্রে আবিরকে দারুণ মানিয়েছে। আর বাবলির নানা অপরগতা সঙ্গে নিয়েই চরিত্রের চার্ম পর্দায় ভাল ধরতে পেরেছেন শুভশ্রী। তবু বলতে হয় চিত্রনাট্যে বাবলির মনের দ্বিধা-দ্বন্ধ আরেকটু ভালোভাবে ধরা যেতে।
মূল গল্পটা কেমন? ইম্ফলে থাকে বাবলির মাসি-মেসো (সোহিনী সেনগুপ্ত-সন্দীপ ভট্টাচার্য)। চাকরিতে যোগ দেওয়ার আগে বাবলি তাদের কাছে গিয়েছিল। এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাবলিকে গাড়ি করে ডিমাপুর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে অভিরূপের ওপর। অপূর্ব সুন্দর পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। তারা ওই রাতের জন্য জঙ্গলে আটকে পড়ে, এক চিলতে কাঠের ঘরে থাকতে বাধ্য হয়। প্রকৃতির কোলে তাদের ভালবাসা গাঢ় হতে সময় লাগেনি। তারপর দু’জনের পথ আলাদা হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে বাবলি কলকাতায় এয়ারপোর্টে স্কুলের বন্ধু ঝুমাকে (সৌরসেনী) দেখতে পায়। ঝুমা স্মার্ট-ঝকঝকে-ছিপছিপে মেয়ে, পেশায় বিমানসেবিকা। বোঝাই যায় ঝুমা আর বাবলির সম্পর্কে সখ্যের ভাগ একটু কম। বাবলি কিছুক্ষণে জেনে যায় ঝুমা অভিরূপের প্রতি অনুরক্ত এবং পূর্ব পরিচিত। ব্যস, তার মন তিক্ততায় ভরে যায়। এরপর আইআরএস অফিসার বাবলি চাকরিতে যোগ দিয়ে দিল্লিতে থাকতে শুরু করে, নিমেষ কাকা ও কাকির সঙ্গে (কৌশিক সেন ও রেশমি সেন)।
[আরও পড়ুন: শার্লক হোমস যদি বাঙালি হতেন, কেমন হত? ‘শেখর হোম’ সিরিজে দেখালেন সৃজিত]
সেখানে আসতে চায় অভিরূপ। নাহ্, আবার দেখা হওয়ার আকর্ষণ এড়াতে পারে না বাবলি। তবে তাদের সম্পর্কের মধ্যে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে ‘ঝুমা’-র উপস্থিতি। স্বাধীনচেতা-উচ্ছল বাবলি আর রোমান্টিক-কেয়ারিং অভিরূপের জার্নি প্রথমার্ধে দেখতে মন্দ লাগে না। রোমান্টিক মুহূর্তগুলো সুন্দর। ঝুমার চরিত্রে সৌরসেনী আক্ষরিক অর্থে ছবির এক্স ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পেরেছেন, যতটুকু আছেন ইন্টারেস্টিং। তবে তার চরিত্র নির্মাণে আরও যত্নের প্রয়োজন ছিল। গল্পে তেমন কোনও বাঁক নেই। ফলে ক্লাইম্যাক্সের জন্য যে অধীর আগ্রহ তৈরি হয়, সেটা কম এই ছবিতে। দু’ঘণ্টা চোদ্দো মিনিটের ছবি ধীর লাগে, শেষটা ছোট হতে পারত। সিনেম্যাটোগ্রাফার মানস গঙ্গোপাধ্যায় চমৎকার কাজ করেছেন। অনেকদিন মনে থেকে যাবে লোকটাক লেকের দৃশ্যটা। ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত ছবির সুরকার। বেশ কয়েকটি গান আছে, শুনতে ভালই লাগে। বিশেষ করে অনুপম রায়ের টাইটেল ট্র্যাক, শ্রেয়া ঘোষাল এবং রূপম ইসলামের গানগুলো। সব মিলিয়ে বলা যায় চিত্রনাট্য আরও জোরালো হতে পারত। তবে চরিত্রগুলোর আদিম আবেগ ভালোই ধরতে পেরেছেন পরিচালক।