সন্দীপ্তা ভঞ্জ: প্রথম মরশুমে 'নষ্টনীড়' ক্ষমতাবিলাস, পালঙ্ক কাঁপানো 'ঠুনকো' পৌরুষত্বকে জবাব দিয়েছিল। এবার দ্বিতীয় মরশুমে সত্যন্বেষণের খেলা আরও ভয়ঙ্কর। একসুতোয় গাঁথা অতীত-বর্তমানের জন্য যেখানে উলট-পালট হয়ে যায় অপর্ণার ভালো'বাসা'। 'নষ্টনীড় ২' বুঝিয়ে দিল এই দুনিয়াতে ফটোফ্রেমে বন্দি 'আইডিয়াল কাপল' শুধুই একটা প্রহেলিকা মাত্র!
ক্ষমতার আস্ফালনের সমাপতন
অপর্ণার স্বামী ঋষভ পেশায় অধ্যাপক। সমাজেও বেশ যশ-খ্যাতি। সোসাইটিতে সম্মান আছে। আচমকাই একদিন ছাত্রীর আনা #MeToo মামলায় জড়িয়ে জেলে যায়। সেখান থেকে ফিরেও সংসার-চাকরি বাঁচাতে নতুন নাটক! এখান থেকেই 'নষ্টনীড় ২'-এর গল্প শুরু। তবে ক্ষমতার আস্ফালন যতই থাকুক সমাপতন বলিষ্ঠ। সব সয়ে স্বামীর পাশে ঠাঁয় টিটিপক্ষীর মতো থেকে যাওয়া নারী যখন প্রতিপক্ষ হয়ে যায়, তার পরিণাম যে মারাত্মক, অপু বুঝিয়ে দিল। দ্বিতীয় সিরিজে পরিণত অপর্ণা সংসার বাঁচাতে মরিয়া নয়, সে তখন মেয়েদের জ্বালা-যন্ত্রণার আঁচ পেয়ে সত্যির খোঁজে উদভ্রান্তের মতো ছুটে বেড়ানো এক মানুষ। স্বামীর বিবাহ বহির্ভূত একাধিক সম্পর্কের কাছে মাথা নত না করে জেল ফেরত স্বামীকে সোজাসুজি চার্জ করার ক্ষমতা রাখে সে।
সংসার'হীন' অপু
সুগৃহিনী অপর্ণার সাজানো সংসার। উচ্চশিক্ষিত, মেধাবী পড়ুয়া হয়েও সংসার আগলায় সে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত, বিত্তশালী স্বামী। মিষ্টি মেয়ে। কিন্তু কখন যে চোরাবালির অতল গহীনে তলিয়ে গেল সেসব বিশ্বাস, ভরসা, আশা, সংসারসুখ… অপু টেরই পায়নি। তাঁর 'নীড়' যে গোড়া থেকেই নষ্ট ছিল, সংসারি অপু সেটা বুঝতে পারেনি। তবে পায়ের তলার মাটি সরে গেল সেদিন, যেদিন ঈশ্বরতুল্য, বন্ধুসম বরের কুকীর্তির আঁচ পেল। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে তাঁর বিশ্বাস। প্রথমে গোধূলি, তারপর সুরমা বিশ্বাস... এরকম আরও কত মেয়েরা যে ভুক্তভোগী তাঁর 'বদজাত' স্বামীর হাতে, সত্যান্বেষণে বেরিয়ে তার খোঁজ পেল অপু। যে শাড়ির আঁচল দিয়ে একসময়ে সযত্নে হেঁশেলের মশলার কৌটো মুছে সাজাতো, সেই আঁচল দিয়েই শ্রীঘর থেকে ফেরা স্বামী যখন হাসপাতালে ভর্তি হল, তার জন্য দৌড়োদৌড়ি করে ঘর্মাক্ত চোখমুখ মুছতে হল। প্যারালালি নিজেই নিজের অস্ত্র হয়ে উঠল অপর্ণা। 'নষ্টনীড় ২'তে দর্শকরা দেখল একজন শক্তিশালী, মানসিকভাবে বলিষ্ঠ, দৃঢ় নারীকে। স্বামীর কুকীর্তির কথা জানতে পেরে, নিজে থেকে আইনিভাবে সরে আসার সিদ্ধান্ত, সমাজের রক্তচক্ষুকে পাত্তা না দিয়ে ব্যক্তিগত 'বিবেকবোধ'-এই অপর্ণা গল্পের হিরো হয়ে উঠল।
অপর্ণার লড়াই
অপর্ণার ভূমিকায় সন্দীপ্তা সেন পয়লা মরশুমের মতোই দ্বিতীয় মরশুমেও ঝাঁজ বুঝিয়ে দিলেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে গল্পের মোড় ঘোরাতে যে অভিনয়ের মাধ্যমে হাতে রাশ টেনে রেখেছিলেন তিনি, তাঁর জন্য বাহবা প্রাপ্য তাঁর। ক্ষমতাবিলাসী অধ্যাপকের চরিত্রে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভালো। 'নষ্টনীড় ২'তে তাঁর চরিত্রের মোড়ক আরও উন্মোচিত। চাকরি আর সংসার বাঁচাতে নিজের ফন্দিফিকিরের জালে জড়ানো এক মানুষের চরিত্রে বেশ মানিয়েছে। যথাযথ অভিনয়। সন্দীপ্তার সঙ্গে প্যারালালি ঊষসী রায় দারুণ। তিক্ত অতীতের জন্য প্রতিশোধস্পৃহ এক নারীমন যে ন্যায়বিচারের আশায় কতদূর যেতে পারে, সেই সীমারেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন 'সুরমা' ঊষসী। সন্দীপ্তার বান্ধবী ও তাঁর প্রেমিকের চরিত্রে রুকমা রায় ও অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় প্রথম সিরিজের মতো এই মরশুমেও অপর্ণার সাপোর্ট সিস্টেম হিসেবে দারুণ।
[আরও পড়ুন: অবসর চাইছেন আমির খান, বিশাল প্রযোজনা সংস্থার দায়িত্ব সামলাবেন ছেলে জুনেইদ!]
ইউএসপি
সিরিজে মোট ৬টি এপিসোড। একটি ভালোবাসার মৃত্যু ভায়া সম্পর্কের বিষফল আবিষ্কার করার পর অপর্ণার খেলা ভাঙার খেলার মাস্টারপ্ল্যান বেশ টানটান। প্রথম সিরিজে গল্প খানিক আলগোছে ঢিমে তালে গেলেও দ্বিতীয় মরশুমে 'নষ্টনীড়' ততটাই পোক্ত। দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়া অপর্ণা যে 'ঠুনকো' সংসারের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে দোষী স্বামীকে যথাযোগ্য শাস্তি দিয়ে সমাজে মেয়েদের মাথা উঁচু করে বাঁচার বার্তা দিল, সেটা বড় পাওনা। বলাই বাহুল্য, বাস্তবের অপর্ণারা একজোট হলে এই পৃথিবী মেয়েদের জন্য আরও সুস্থ, স্বাভাবিক 'ঘর' হয়ে উঠবে, সেটা 'নষ্টনীড় ২' বুঝিয়ে দিল। এর জন্য পরিচালক অদিতি রায় এবং গল্পকার সম্রাজ্ঞী বন্দ্যোপাধ্যায়কে কুর্নিশ জানাতেই হয়। শেষপাতে বলে রাখি, 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে…', 'মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু…', সমাজের এই প্রচলিত বস্তাপচা রদ্দিমার্কা ধ্যানধারণা বদলের জন্য আবারও কড়া নেড়ে গেল ‘নষ্টনীড় ২’ সিরিজ।