দেশটা কার? ‘উড়োজাহাজ’ ছবিতে এই প্রশ্ন তোলে ‘বাচ্চু মণ্ডল’। সাধারণ কার মেকানিক প্লেন চালানোর স্বপ্ন দেখেছিল। বাদ সাধে রাষ্ট্র। এই প্রশ্ন বারবার তুলতে চান পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। শুনলেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
জঙ্গলের মধ্যে আলোটা বেশ মায়াবী। ভোরবেলা না বিকেলবেলা বোঝা যায় না। পাখির ডাক, এমনকী গাছ থেকে পাতা পড়ার শব্দটাও শোনা যায়। এতটাই নির্জন। মানুষের পা পড়ে না এই জঙ্গলে। সেখানে আমরা বাচ্চু মণ্ডলকে দেখতে পাই। কার মেকানিক বাচ্চু এখন জঙ্গলে যাতায়াত করে। তার আকাশে ওড়ার স্বপ্ন এতদিনে পূর্ণ হবে। সে খুঁজে পেয়েছে একটা এরোপ্লেন। বহু পুরনো একটা প্লেন, কবেকার, কে জানে! সেটাকে সারিয়ে, রং করে তুলতে দিন রাত এক করে দিচ্ছে। কাজ পালিয়ে, বউকে ফাঁকি দিয়ে চুপিচুপি এই কাজ করে চলেছে।
কিন্তু বাচ্চু একা নয়। জঙ্গলে আরও মানুষ আছে যারা বেঁচে ছিল এককালে। এখন তারা অতীত। তাদের মারা যাওয়ার খবর হয়তো খবরের কাগজে পড়েও থাকতে পারি আমরা। আহা, খবরের কাগজে তো প্রায়ই এমন মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। আত্মহত্যা, বউকে খুন, এসব তো সয়ে গিয়েছে আমাদের। মনেও রাখি না। প্রতিদিনকার হিংসা এতই সহজ এখন আমাদের কাছে। জঙ্গলে বাচ্চুর সঙ্গী সেই লোকটা জানায় যে ভাত খেতে সে বড় ভালবাসত। চাষবাস করত বোধহয়। তারপর ভাতও জোটেনি। বউ ভাত দিতে পারেনি বলে পেটের জ্বালায় দিয়েছে বউকে মেরে। ব্যস। সেও এখন পরলোকে। বাচ্চুকে বলেছিল নিজের দুঃখের কথা- ‘কত লোকে কত কী খায়। আমি তো শুধু একটু ভাতের স্বপ্ন দেখেছিলাম।’
জঙ্গলের মধ্যে বাচ্চুর কাছে প্রতিদিন এইসব মৃত মানুষেরা ভিড় করে। তাদের কথা শুনতে শুনতেও বাচ্চু দমে না। প্লেন ওড়ানোর স্বপ্ন দেখে।
[ আরও পড়ুন: ‘মোদি ভাল’, কংগ্রেসে যোগ দিয়ে বিস্ফোরক অভিনেত্রী উর্মিলা ]
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সাম্প্রতিক ছবি ‘উড়োজাহাজ’ এই বাচ্চুদের কথা বলে যারা খুব সাধারণ হয়েও অসাধারণ স্বপ্ন দেখতে পারে। যারা খুব সরল সাদাসিধে মানুষ হওয়া সত্ত্বেও রাষ্ট্রের কাছে এমন সব প্রশ্ন তোলে যা রাষ্ট্রকে অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। এরা রাষ্ট্রের কাছে বাড়তি, অস্বস্তি, বিপদ। কারণ এরা রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করে। সম্প্রতি ‘উড়োজাহাজ’-এর স্ক্রিনিংয়ের পর কথা হচ্ছিল পরিচালক বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের সঙ্গে, তাঁর বাড়িতেই। খবরের কাগজে একটা ছোট্ট ঘটনা এই ছবির জন্ম দেয়। কিন্তু সেখান থেকে পরিচালক ছবিটাকে এমন একটা রূপ দিয়েছেন যেখানে ছবিটা ভীষণভাবে একটা রাজনৈতিক ছবি হিসেবে মনে দাগ কাটে। এই রূপান্তর কীভাবে ঘটল?
পরিচালকের নিজের কথায় ‘আমাদের চারপাশের চেহারাটা সাহায্য করেছে। বছর দুই আগে থেকেই এই ভাবনাটা মাথায় ছিল। আমার বারবার মনে হয়েছে স্টেট-এর তৈরি টেররের কথা। এই দেশে বসে স্টেটের যে রোলটা দেখতে পাচ্ছি সেটাই ছবিতে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আমাকে সবচেয়ে বেশি ভাবায় রাষ্ট্রের ব্যাপারটা। রাষ্ট্র বিভিন্ন ভাবে ফিরে আসে আমার ছবিতে। কিছুদিন আগে একটি বাংলা ছবির প্রদর্শন বন্ধ করা হল। কোনও উত্তর নেই। স্টেট ইজ নট আন্সারেব্ল ফর দি টেরর ইট ক্রিয়েটস।’
সেইসঙ্গে সোহিনী দাশগুপ্ত যোগ করলেন, ‘যখন স্ক্রিপ্ট লেখা হচ্ছে আমাদের নানা কিছু মনে হয়েছে। এই যে আমাদের চারপাশে ক্রমাগত ভায়োলেন্স দেখি এবং আমরা সেটাতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কেউ খুন হচ্ছে, কেউ বান্ধবী বা বউকে বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলছে, কেউ মরছে খিদের জ্বালায়, এই ব্যাপারগুলো আমাদের গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ঘটনাগুলো তো স্বাভাবিক নয়। কিন্তু এগুলো আমরা আর আলাদা করে লক্ষ করি না। এই বিষয়টা যাতে ছবিতে রাখা যায় সেটা ভেবেছিলাম।’ তখনই জিজ্ঞেস করলাম যে লোকটা ভাত খেতে না পেয়ে মরল, তাকে দেখে কিন্তু কৃষক আত্মহত্যার কথাই মনে হয়েছে। ‘কৃষক আত্যহত্যার ঘটনা তো নতুন নয়। প্রায় পনেরো কুড়ি বছরের ইতিহাস। সেটা অবশ্যই ব্যাক অফ দ্য মাইন্ড ছিল’, বললেন সোহিনী।
[ আরও পড়ুন: মেয়ের জীবনসঙ্গী হিসেবে রণবীরকে কতটা পছন্দ, অকপট আলিয়ার মা ]
বুদ্ধদেব নিজে এমন আউটসাইডারদের নিয়ে ছবি করতে পছন্দ করেন, তাঁর ছবিতে ব্যক্তি বনাম রাষ্ট্র এই থিম ঘুরে ঘুরে আসে। তিনি কি নিজেকে দলছুট বলে মনে করেন? উত্তরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বললেন, ‘দেখো তুমি যখনই স্রোতে গা ভাসাবে তখনই তার দাম দিতে হবে। আমি যখন দেখি আমার চারপাশে বন্ধুস্থানীয়রা সাবমিট করছে রাষ্ট্রের কাছে তখন মনখারাপ হয়, একা লাগে।’ এই ছবিতে বাচ্চু মণ্ডল খুব জরুরি একটি প্রশ্ন তোলে ‘দেশটা কার?’ এই প্রশ্ন পরিচালকেরও। ‘এটা সত্যি আমারও প্রশ্ন। রাষ্ট্র যদি বলে এটা আমার দেশ এবং যা খুশি তাই করে তাহলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের যারা, জঙ্গলমহলের যারা, আদিবাসী সম্প্রদায়ের যারা, তারা কী করবে? তাদের কী উত্তর দেব? এই অদ্ভুত ডাইকোটমির মধ্যে দিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমার মনে হয় এই বিষয় নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া উচিত।’
‘উড়োজাহাজ’ তৈরি করার সময় বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত। তবু পিছিয়ে আসেননি। তিনি মনে করেন ভাবনার স্তরে অশক্ত শরীর অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় না। এই বছরে দুটো ছবির প্ল্যান রয়েছে। তিনি বললেন, ‘একটা আমার ছবি, অন্যটা সোহিনী পরিচালনা করবে। কোনটা আগে হবে এখনই বলা যাচ্ছে না।’ ‘উড়োজাহাজ’ খুব শীঘ্রই মুক্তি পাওয়ার কথা। সবশেষে বুদ্ধদেব বলেই ফেললেন, ‘দর্শক এখনও ভাল ছবি দেখতে চায়। আমি পুরস্কারও কম পাইনি, কিন্তু ছবি করি কারণ সিনেমা আমার জীবন, সিনেমার মধ্যে দিয়েই আমি বাঁচতে চাই।’
The post স্বপ্নে মোড়া বাস্তব আর ‘উড়োজাহাজ’, নতুন ছবির গল্প বুনলেন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত appeared first on Sangbad Pratidin.