সোমনাথ রায়, পুলওয়ামা: “আরে ইয়ে কৌনসা তার হ্যায়...?” গাড়ি তখন ছুটছিল দক্ষিণ কাশ্মীরের বিজবেহারা এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামের ভিতর দিয়ে। দক্ষিণ কাশ্মীর জুড়ে চলছে ভোটগ্রহণ পর্ব। রাস্তাঘাট কার্যত শুনশান। গ্রামের ভিতরের রাস্তাতেও তাই গাড়ির স্পিড ছিল ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটারের বেশি। হঠাৎ করেই ব্রেক কষলেন ড্রাইভার সাবির আহমেদ বেগ। রাস্তার এপার থেকে ওপার যাওয়া ইঞ্চি তিনেক বেড়ের মোটা কালো তার দেখে বললেন, “ভোটের দিন অনেক কিছুই হতে পারে। চোখ কান খোলা রাখা ভাল।” ভাল করে দেখে ও ক্ষেতে জল দেওয়ার পাম্পের আওয়াজ শুনে আশ্বস্ত হলেন ‘তেমন কিছু নয়’। তারপর আবার গড়াতে শুরু করল চাকা।
বুধবার জম্মু-কাশ্মীরের সাত জেলার ২৪টি কেন্দ্রে হল ৩৭০ পরবর্তী যুগের প্রথম বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফা। কাশ্মীরের যে চার জেলায় ভোটদান হল সেগুলি - অনন্তনাগ, কুলগাম, পুলওয়ামা ও সোপিয়ান। প্রত্যেকটির গায়ে লেগে আছে সন্ত্রাসবাদের গন্ধ। জম্মুর ৮ ও কাশ্মীরের ১৬টি কেন্দ্রের তিন হাজার ২৭৬টি বুথে ২১৯ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারণের দায়িত্বে ছিলেন ২৩ লক্ষ ২৭ হাজার ভোটার। বিতাড়িত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্য দিল্লিতেও করা হয়েছিল চারটি বুথ। সেখানেও মতদান করতে দেখা গেল অনেককে।
সকাল সকাল রওনা দেওয়ার সময়ই সাবির ভাইকে বলা ছিল, হাইওয়ে নয়। গাড়ি নিয়ে যেতে হবে বিভিন্ন গ্রামের ভিতর দিয়ে। চেষ্টা করতে হবে যত বেশি সংখ্যক পোলিং স্টেশনের ছবি চাক্ষুস করা যায়। সেইমতো সাপের মতো একেবেঁকে যে পথে দিয়েই যাচ্ছিল গাড়ি, সাবিরভাই বলছিলেন, “ইয়ে ইলাকা মিলিট্যান্ট সে ভরা থা...”, “ইয়ে ইলাকে মে বহত কিলিং হুয়া, ওহো হো...”। কাশ্মীর সম্পর্কে যাঁরা পরিচিত, তাঁদের কাছে অজানা নয়। যাঁরা খুব একটা জানেন না, তাঁরাও ইন্টারনেটে সন্ত্রাসবাদ ও দক্ষিণ কাশ্মীরের সম্পর্ক নিয়ে একটু খোঁজ করলেই সম্যক ধারণা পেয়ে যাবেন। বুরহান ওয়ানি, জাকির মুসা, আদিল আহমেদ দার - একের পর এক কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদীর জন্ম, বেড়ে ওঠা এই সব এলাকায়।
নয়ের দশকে পণ্ডিতদের উপর আক্রমণ থেকে শুরু করে এই কয়েকবছর আগে টার্গেট কিলিং। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে সন্ত্রাসের, আতঙ্কের আর্তনাদ আজও কানে আসে। ৩৭০ পূর্ববর্তী শেষ নির্বাচন ছিল ২০১৯ সালের লোকসভা। সেই সময়ও ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। ফলে হাতেগোনা কয়েকটি বুথ ছাড়া বেশিরভাগেই মাছি মারতে দেখা গিয়েছিল ভোটকর্মীদের। এবারের ছবিটা একেবারে অন্য। সার্বিকভাবে ভোটদান হল ৫৮.৯৭%। সর্বাধিক ৭৭.২৩% ভোট পড়েছে জম্মুর কিস্তওয়ার জেলায়। আদিল আহমেদ দারের জেলা কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সর্বনিম্ন ৪৬.০৩%। ইতিহাসের কথা মাথায় রাখলে যা প্রশংসনীয়। সোপিয়ান (৫৩.৬৪%), অনন্তনাগ (৫৪.১৭%) ও কুলগাম (৬১.৫৭%)-এ যে হারে ভোটদান হল তাও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কেন্দ্রভিত্তিক হিসাব দেখলে সবথেকে বেশি ৮০.০৬% ভোট দিয়েছেন জম্মুর ইন্দেরওয়াল কেন্দ্রের ভোটার। কাশ্মীরের ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভোটদান হয়েছে পহলগামে (৬৭.৮৬%)। সবথেকে কম (৪০.৫৮%) ভোট দিয়েছেন বুরহান ওয়ানির কেন্দ্র ত্রালের মানুষ। তবু মোটের উপর কাশ্মীরের ইতিহাস মাথায় রাখলে ভোটদানের পরিমাণ খুবই ভাল।
কোন জাদুতে হঠাৎ এত সংখ্যক কাশ্মীরি গণতন্ত্রের উৎসবে মাতলেন? বেশিরভাগ স্থানীয় যা বললেন, তার নির্যাস, “৩৭০-এর অপমানের জবাব দিতে ও কোনওভাবেই যাতে বিজেপি কাশ্মীরে জিততে না পারে, তা সুনিশ্চিত করতে।” ভোটদানের হার এত বেড়ে যাওয়ার একটা দিক তো, যাঁরা বয়কট করতেন তাঁদের ফিরে আসা? ‘যাদের’ ডাকে হত ভোট বয়কট, ‘তাদের’ একজন জামাতের নির্দল প্রার্থী সায়ার আহমেদ রেশি। বিষয়টা চিন্তার নয়? জনতার ভিড়ের মধ্যে তারিগামের সরকারি হাই স্কুলে নিজের ভোট দিয়ে বেরিয়া আসার পর কাঁধ থেকে সমর্থকদের দিকে আঙুল তুলে সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, তথা ১৯৯৬ থেকে কুলগামের বিধায়ক বলছিলেন, “এই উৎসাহ দেখতে পাচ্ছেন না? আমি স্কুলে আগুন লাগাইনি, নতুন স্কুল বানিয়েছি। পথ ভেঙে দিইনি, ব্রিজ বানিয়েছি।”
কুলগাম থেকে পৌনে ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছনো গেল বিজবেহারায়। স্থানীয় ইসলামিয়া হাইস্কুলে ভোট দিতে এলেন মেহবুবা মুফতির মা গুলশন আরা। বার হওয়ার পথে বললেন, “যাঁরাই ক্ষমতায় আসুক, পরিস্থিতর উন্নতি হোক।” বেশ বেলায় ভোট দিলেন মেহবুবা, তাঁর মেয়ে তথা স্রিগুফওয়ারা-বিজবেহারা কেন্দ্রের পিডিপি প্রার্থী ইলতিজা মুফতি, দুরু কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী গুলাম আহমেদ মীর, পুলওয়ামার পিডিপি প্রার্থী ওয়াহিদ পারা দামহালের এনসি প্রার্থী সাকিনা ইতোরা। এর মাঝেই ছাপ্পা ভোট নিয়ে ন্যাশনাল কনফারেন্স-পিডিএফ তরজা চরমে উঠল। পিডিপি প্রার্থী মেহবুবা মুফতির মেয়ে ইলতিজার বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোটের অভিযোগ আনলেন ন্যাশনাল কনফারেন্স প্রার্থী ড. বসির আহমেদ। বুরখার আড়ালে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে। আবার একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে এনসির বিরুদ্ধে ভোটারদের টাকা বিলোনোর অভিযোগ করেছে পিডিপি। কুলগামের কিছু ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে জামাত প্রার্থী রেশিকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়রা। এছাড়া তেমন আর কোনও উত্তেজনা বা অশান্তির খবর সামনে আসেনি।
আগামী ২৫ সেপ্টেম্বর ও ১ অক্টোবর পরের দু’দফার ভোট। হরিয়ানার সঙ্গেই ফলপ্রকাশ ৮ অক্টোবর। সেদিন কারা জম্মু-কাশ্মীরের ভাগ্যবিধাতা হওয়ার সুযোগ পায়, সেদিকে নজর থাকছে গোটা দেশের। ভোটদান পর্ব মিটতেই কাশ্মীর জুড়ে এল বৃষ্টি। দেখার শুধু অতীতের যা কিছু কলঙ্কিত ইতিহাস, এদিনের ভোটদান ও তার পরবর্তীতে বৃষ্টিতে তা ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যায় কিনা!