shono
Advertisement

টলিউডের সর্বকালের বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার! সত্যজিৎ সম্পর্কে কী বলেন মাধবী?

বেশ কিছু অতিস্পর্শকাতর বিষয়ে নিজের আবেগের কথা নিয়ে অকপট মাধবী মুখোপাধ্যায়।
Posted: 05:00 PM Aug 26, 2023Updated: 05:00 PM Aug 26, 2023

সত‌্যজিৎ রায়ের সঙ্গে নিজের সম্পর্ক নিয়ে খোলামেলা মাধবী মুখোপাধ‌্যায়। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি ’৯২-এ সেই প্রথম। ঝড় তোলা সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক এস এন এম আবদি। বিতর্কের সুনামি উঠেছিল। এখন অনুবাদ করলেন শীর্ষেন্দু চক্রবর্তী। আজ থেকে প্রকাশিত হবে কয়েক কিস্তিতে। কেন সত‌্যজিৎ বলেছিলেন, ‘‘জীবনে এত কিছু করেছি, সমাজ কি আমার একটা অপরাধ মেনে নেবে না?’’ এরকম বেশ কিছু অতিস্পর্শকাতর বিষয়ে নিজের আবেগের কথা সেসময়ে অকপটে বলেছিলেন মাধবী। তারপরেও কিছু জায়গায় এ প্রসঙ্গে মুখ খুলেছিলেন বটে, কিন্তু এই মূল সাক্ষাৎকারটির কাছাকাছিও ছিল না পরবর্তী বক্তব‌্যগুলি। এমনকী, নিজের বিয়ের প্রসঙ্গেও বলেছিলেন, ‘‘অন‌্যকে সাহায‌্য করা।’’ তিন দশক পর শতাব্দীর সেরা সাক্ষাৎকারটিকে ফিরে দেখা।

Advertisement

আপনার সেরা সিনেমা কোনটি?
– সত্যজিৎবাবুর পরিচালনায় ‘চারুলতা’।

কিন্তু এটা সত্যজিতের সঙ্গে আপনার প্রথম সিনেমা ছিল না, তাই তো?
– না। এটা আমাদের প্রথম সিনেমা নয়। ওঁর পরিচালনায় আমি প্রথম কাজ করি ‘মহানগর’ ছবিতে। এর পর ‘চারুলতা’ এবং ‘কাপুরুষ’। তবে আমার মনে হয় জীবনের সেরা অভিনয় ‘চারুলতা’তেই করেছি। সত্যজিৎও বিশ্বাস করতেন তাঁর তৈরি সেরা সিনেমা ‘চারুলতা’ই। এক বার নয়, বার বার তিনি এ কথা বলেছিলেন।

কিন্তু আপনি তো সত্যজিতের আবিষ্কার নন?
– এই পেশায় এসেছি খুবই ছোটবেলায়। আমার প্রথম ছবি, ‘দুই বেয়াই’ পরিচালনা করেছিলেন দীনেন্দ্রনাথ মিত্র। দীনেন্দ্র নিজেও এক জন প্রথিতযশা পরিচালক ছিলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক ছবিতে কাজ করেছি। আমার যখন ১৩ বছর বয়স, তখন তপন সিংহ তাঁর ‘টনসিল’ ছবির জন্য মুখ্যচরিত্রে আমায় বেছে নেন।

টনসিল?
– হ্যাঁ। ছবির গল্প ছিল এমন একটি দুর্বল এবং অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে যে টনসিলাইটিসে ভুগছে। বাস্তবেও আমাদের পরিবারের অবস্থা একেবারেই ভাল ছিল না। আমি ছিলাম রোগা এবং অপুষ্ট। ফলে চরিত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে গিয়েছিলাম। ওই সিনেমার জন্য জীবনে প্রথম শাড়ি পরেছিলাম। তপনবাবুকে ধন্যবাদ যে, তিনি আমার চেয়েও রোগা, আমার চেয়েও অপুষ্ট কাউকে চরিত্রটির জন্য বেছে নেননি। আপনি হয়তো জানেন যে আমার পরিবার পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু।

টনসিল’-এর পর দীর্ঘ দিন হাতে কোনও কাজ ছিল না। উপার্জনের জন্য শখের থিয়েটার করা শুরু করি। শৈশব থেকেই আমার উপর পরিবারের দেখভালের দায়িত্ব ছিল। আমিই পরিবারের মূল রোজগেরে ছিলাম। এই ‘চরিত্রে’ আমি আমার সেরাটা দিতাম। থিয়েটার থেকে যে সামান্য অর্থ রোজগার হত তা দিয়েই কোনও মতে আমাদের সংসার চলত। এই সময়ে মৃণাল সেন তাঁর পরবর্তী সিনেমার জন্য নতুন মুখের খোঁজ করছিলেন। মৃণালদার কাছে আমার নাম প্রস্তাব করেন তাঁর পরিচিত এক জন। এর পর এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের পর মৃণালদা আমায় ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর জন্য বেছে নেন। সাক্ষাৎকারে আমায় মৃণালদা যা যা প্রশ্ন করেছিলেন আমি সব কিছুতেই ‘হ্যাঁ’ বলেছিলাম। আমার ভয় ছিল, এক বার ‘না’ বললেই আমার বদলে অন্য কাউকে তিনি বেছে নেবেন।

আমায় জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, আমি মাটির ঘরে গোবর নিকোতে পারি কি না? আমি উত্তর দেওয়ার আগেই গীতাবউদি (মৃণালদার স্ত্রী) বলেছিলেন যে, এই কাজ যে কেউ করতে পারবে। সেই সময় গীতা বউদিকে আমার রক্ষাকর্তা বলে মনে হয়েছিল। সেই সময় থেকেই আমি যেন তাঁর শিষ্যা হয়ে গিয়েছিলাম। পরে মৃণালদা বলেছিলেন যে, তিনি তাঁর দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে আমায় কেমন লেগেছিল। তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে আমায় ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর জন্য বেছে নেওয়া হয়।

‘বাইশে শ্রাবণ’-এ আপনাকে দেখার পরই কি সত্যজিৎ আপনার মহড়া নেন?

–  না। সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাই অনেক পরে। ‘বাইশে শ্রাবণ’-এর পরেও আমার হাতে তেমন কাজ ছিল না। বহু চুক্তিপত্রে সই করি এবং বহু মহড়াতে যাই। কিন্তু আখেরে তেমন লাভ হচ্ছিল না। এক বার আমায় সুচিত্রা সেনের মেয়ের ভূমিকাতেও ভাবা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। তবে হাল ছাড়িনি। আমার ধৈর্যের অভাব ছিল না। যখনই সুযোগ পেয়েছি, তখনই কাজ করেছি। 

[আরও পড়ুন: ‘মুসলিম সহপাঠীকে পেটাও’, যোগীরাজ্যের শিক্ষিকার ‘নির্লজ্জ’কাণ্ডে গ্রেপ্তারের দাবি স্বরা-প্রকাশদের]

সত্যজিৎবাবু আমায় ডেকে পাঠান ঋত্বিক ঘটকের ‘সুবর্ণরেখা’য় দেখার পর। তিনি আমায় ‘মহানগর’-এর জন্য ভেবেছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলাম, সত্যজিৎবাবু নির্ঘাৎ আমায় দেখেই বাতিল ঘোষণা করবেন। নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি কোনওভাবেই তাঁর প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারব না। অন্য একটি সমস্যাও ছিল। তাঁর লেক টেম্পল রোডের বাড়ি থেকে আমার বাড়ি ছিল অনেক দূরে। ট্যাক্সি ভাড়া করে তাঁর বাড়ি যাওয়া আমার কাছে টাকা নষ্টের সমান বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু মা বলেছিলেন, কী হবে তা না ভেবে আমার দেখা করতে যাওয়া উচিত। যাব কি যাব না- এই নিয়ে যখন আমাদের দু’জনের তর্ক হচ্ছে, তখনই সত্যজিৎবাবুর কাছ থেকে যাঁরা এসেছিলেন তাঁরা আবার এসে উপস্থিত হলেন। তাঁদের মধ্যে এক জন ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ কিছু টাকা দিলেন। লজ্জাবনত হয়ে বলেছিলাম, ট্যাক্সি ভাড়া না দিলেও ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। তবে তাঁরা কিছুটা জোর করেই ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে গেলেন।

সত্যিই কী চিত্তাকর্ষক জীবন আপনার!
আজ আপনাকে গোটা সত্যিটা বলতে চাই। সত্যজিৎবাবুর সঙ্গে একেবারেই সাধারণ একটি শাড়ি পরে দেখা করতে গিয়েছিলাম। মুখে সামান্যতম মেকআপও ছিল না। তাঁকে প্রভাবিত করার কোনও চেষ্টাই করিনি। আমি যেমন, ঠিক সেই ভাবেই তাঁর কাছে নিজেকে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম। আসলে পুরোটাই ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলাম। যাই হোক, তিনি আমায় বললেন যে, শুটিংয়ের কাজে বাইরে যাচ্ছেন। ফিরে এসে কথা বলবেন।

তাঁর এই কথাই যথেষ্ট ছিল, তাই তো?
তিনি আবার আমায় ডেকে পাঠালেন। চমকে দিয়ে তিনি আমার হাতে একেবারে চিত্রনাট্য ধরিয়ে দিলেন। নির্বাচিত হয়েছিলাম তা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। একটি নায়িকা-কেন্দ্রিক সিনেমার মূল চরিত্রের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলাম। এর আগে আমি যে সব সিনেমায় অভিনয় করেছিলাম সেগুলি ছিল নায়ক-কেন্দ্রিক।
‘মহানগর’-এর শেষ দিনের শুটিংয়ের কথা আমি ভুলব না। শেষ দিনের শুটিং ছিল আউটডোর। সে দিন সত্যজিৎবাবু বলেছিলেন, ‘‘আবার কবে আমরা একসঙ্গে কাজ করব?’’ আমি এই কথার কোনও উত্তর দিতে পারিনি। বিমোহিতের মতো তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলাম মাত্র। কোথায় তাঁকে বলব যে আমি তাঁর সঙ্গে কাজ করতে চাই, উলটে তিনিই আমার সঙ্গে কাজ করতে চাইছেন! আমি যেন আমার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। (ক্রমশ)

[আরও পড়ুন: জাতীয় পুরস্কার পেলেন ‘বিনোদিনী’ পরিচালক রামকমল, ‘বড় সার্টিফিকেট’ প্রযোজক দেবের]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement