সুপ্রিয় সেন: হারানো সময় হাতছানি দেয় পুজোর দিনগুলোয়। মনে পড়ে কত কথা! চোখের সামনে বদলে গেল দিনকাল। এত থিম, এত আলো তখন ছিল না। কলকাতায় যাও বা ছিল শহরতলির পুজোর ছবিটা একদম অন্যরকম।
আমাদের কাছে পুজো মানেই ঠাকুমার তৈরি কুচো নিমকি। সঙ্গে নারকেল নাড়ুও থাকত। কিংবা ছাপা সন্দেশ, গজা। কিন্তু নিমকির উপরে আমার আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশি। জিভের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল লাজবাব। মুখে দিলেই যেন চেতনায় ছড়িয়ে যেত আশ্চর্য সুখ!
বিজয়ায় আমরা যেতাম টালিগঞ্জে বড়জেঠুর বাড়ি। ওখানেই ঠাকুমা থাকত। বাবারা চার ভাই একসঙ্গে বিজয়া করত সেদিন। আর ঠাকুমা সবার পাতে তুলে দিত নিমকি, গজা, সন্দেশ, নাড়ু। সে এক রঙিন দিন! পুজো শেষের বিষণ্ণতা মুছে যেত ভাইবোনদের সঙ্গে হইহই আর পছন্দের সব খাবারকে সঙ্গী করে। মনে পড়ে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই বিল্টু তাক করে থাকতাম একে অন্যের পাত থেকে নিমকি তুলে নেওয়ার জন্য। তার পর এই নিয়ে শুরু হত ঝগড়া। তবে তাতে মজাও কম হত না। আবার অন্য কিছুতে মেতে উঠে মুহূর্তে ভুলে যেতাম একটু আগের কলহ-মুহূর্ত। বাড়ির বড়রা এসবে মাথাও ঘামাতেন না। উৎসবের দিনগুলো ছিল শাসনবিহীন ঝলমলে আলোয় ভরা।
বিজয়া দশমীর দিন ও তার পরের দিনগুলোয় বাড়িতে আসতেন অতিথিরা। তাদের আপ্যায়নে ফাস্ট ফুডের প্রয়োজন হত না। বাড়িতে তৈরি নাড়ু-সন্দেশেই সকলে খুশি হতেন। তবে আমি আলাদা কৌটোয় কুচো নিমকি রেখে দিতাম। কেউ তাতে ভাগ বসাতে এলেই চেঁচিয়ে মাথায় করতাম। সকলে আমাকে দেখে কুটিপাটি হত হেসে। ছোটকাকা মজা করে সেই কৌটো লুকিয়ে রাখত। তার পর তা নিয়ে শুরু হত চূড়ান্ত হট্টগোল। আজ ঠাকুমার মতো কাকাও নেই। অমন এক মজলিশি মানুষকে খুব মিস করি। ছোট হোক বা বড়, সকলের সঙ্গেই যে আড্ডা জমাত অনায়াসে।
বড় হতে হতে সব কিছুই বদলে গেল। কখন যে মোমো-পিৎজা-এগরোলের ভিড়ের পাশাপাশি দোকানের নানা রকম কায়দার মিষ্টি ঢুকে পড়ে দখল করে নিল নিমকি-গজার আধিপত্য বুঝতেই পারিনি। তবে হারাতে গিয়েও সব হারায় কি? স্মৃতির কুয়াশায় মিশে থাকে মনকেমনের দিনবদল। ঠাকুমা নেই। কতদিন হয়ে গেল। আজও পুজো এলে উৎসবের আয়োজন পুরনো দিনের কথা মনে করায়। আর দশমী এলেই মনে পড়ে নিমকি, হইহই আর রাতের হিমমাখা সময়টার কথা।
কিন্তু আজ কি পুজো কেবলই স্মৃতিচারণ? তা নয়। আজকের পুজো আজকের মতো। দোকানে দোকানে বিকোয় নাড়ুর প্যাকেট। মেলে কুচো নিমকিও। সে নিমকিতে অবশ্য ঠাকুমার সস্নেহ ছোঁয়া নেই। তবু তাতেই খুশি থাকতে হয়। খুঁজে নিতে হয় হারানো দিনের স্বাদগন্ধ।