স্টাফ রিপোর্টার: আন্তর্জাতিক ফুটবলের খোঁজখবর রাখেন যাঁরা, স্তানিস্লাভ লোবোৎকাকে তাঁদের চেনা উচিত। স্লোভাকিয়া মিডফিল্ডার এ মুহূর্তে বিশ্বের নামীদামি ক্লাবের অন্যতম কাঙ্খিত ফুটবলার! বার্সেলোনা পর্যন্ত তাঁকে নিতে চেয়েছিল। তা, পরিস্থিতি যা, উনত্রিশ বছরের লোবোৎকাই রোববার ইংল্যান্ডের কোয়ার্টার ফাইনাল যাত্রার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান বাধা হতে চলেছেন।
কাকতালীয় লাগলেও স্লোভাকিয়া ফুটবলের উত্থান-পতনের সঙ্গে লোবোৎকার একটা সূক্ষ্ম মিল রয়েছে। গত ইউরোর সময় ফর্ম খুব খারাপ ছিল তাঁর। ওজন বেড়ে গিয়েছিল। স্পেনের কাছে পাঁচ গোলে চূর্ণ হয়ে সেই ইউরো থেকে বিদায় ঘটে যায় স্লোভাকিয়ার। লোবোৎকারও। কিন্তু তার পরের সময়টা যেমন স্লোভাকিয়া ফুটবলের উত্থান-কাহিনি লিখেছে, তেমন লিখেছে লোবোৎকারও। দেখতে গেলে, দেশজ ফুটবলের পরিবর্তনের নেপথ্যে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। ইতালির ফ্রান্সেসকো কালজোনা স্লোভাকিয়া কোচ হয়ে আসার পর ভাগ্য আরও খুলে যায় লোবোৎকার। ইতালির ক্লাব নাপোলিতে মরিসিও সারি-র সহকারি হিসেবে কাজ করতেন কালজোনা। হেড কোচ হিসেবে স্লোভাকিয়া ফুটবল ফেডারেশনের কাছে তাঁর নাম প্রস্তাব করেন মারেক হামসিক। যিনি কি না স্লোভাকিয়ার সর্বকালের সেরা গোলস্কোরার। বর্তমানে জাতীয় দলের সাপোর্ট স্টাফ হিসেবে যুক্ত। ২০২৩ সালে হামসিক খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর নতুন নেতা প্রয়োজন ছিল কালজোনার। দু’জনকে তিনি বেছে নেন। প্রথম জন, ওন্দ্রে দুদা। দ্বিতীয় জন, লোবোৎকা।
এখানে লিখে রাখা যাক, চলতি ইউরোর গ্রুপ পর্বে যে লড়াকু ফুটবল খেলে নকআউটে উঠেছে স্লোভাকিয়া, তার নেপথ্যে বড়সড় ভূমিকা রয়েছে লোবোৎকার। বেলজিয়ামের বিরুদ্ধে যে ম্যাচ এক গোলে জেতে স্লোভাকিয়া, সেই ম্যাচের সেরা ফুটবলার নির্বাচিত হন তিনি। আবার রোমানিয়ার সঙ্গে ১-১ ড্রয়ের ম্যাচেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আগে আক্রমণভাগের প্লেয়ারদের বল পাস করাই কাজ ছিল তাঁর। কিন্তু কালজোনা আসার পর নিজের খেলা বদলে ফেলেন লোবোৎকা। ড্রিবল করতে তিনি বরাবরই পছন্দ করতেন। জাতীয় দলের নতুন কোচ তাঁকে সেই স্বাধীনতা দেওয়ায়, টিম হিসেবে আরও ধারালো হয়ে উঠেছে স্লোভাকিয়া।
[আরও পড়ুন: রোহিতদের খেলায় হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল ধোনির! বন্ধু দ্রাবিড়ের সাফল্যে আপ্লুত শচীন-সৌরভ]
অতএব– আজ কাজ সহজ হবে না ইংল্যান্ডের। অতএব, ব্রিটিশ কোচ সাউথগেটকে স্লোভাকিয়া মাঝমাঠের ‘হৃদয়’-কে আটকানোর কোনও না কোনও পন্থ খুঁজে বার করতে হবে। ইংল্যান্ড কোচ সাউথগেট বুঝতে পারছেন, লোবোৎকা তাঁর কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠার ক্ষেত্রে ঠিক কত বড় বাধা হতে পারেন? ‘‘স্লোভাকিয়া ব্যাক থেকে খেলাটা শুরু করতে চায়। আর সেই সিস্টেমে স্তানিস্লাভ লোবোৎকা বিশাল ফ্যাক্টর। খেলার গতি কী হবে, সেটা ঠিক করে ও। তা ছাড়া স্লোভাকিয়া ফরোয়ার্ডদের দ্রুত ওঠার একটা প্রবণতা রয়েছে। ওরা আগ্রাসী ভাবে প্রেস করতেও জানে। সেই প্রেসিংটা আমাদের বন্ধ করতে হবে। একটা অন্য রকম পরীক্ষার মধ্যে পড়তে চলেছি আমরা,’’ শনিবার বলে দিয়েছেন সাউথগেট।
এমনিতেই অবস্থা খুব একটা সুবিধের নয় সাউথগেটের ইংল্যান্ডের। গ্রুপ পর্বে ‘থ্রি লায়ন্স’ না হারলেও পরপর দু’টো ম্যাচ ড্র করে প্রবল বিড়ম্বনায় পড়েছে। স্তুপাকৃত সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছে। স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে আবার যদি কোনও ছন্দপতন ঘটে, কোনও ভাবে যদি হেরে যায় ইংল্যান্ড, তা হলে সাউথগেটের টিমের ইউরো অভিযান কিন্তু এবারের মতো শেষ হয়ে যাবে।
খবর যা, ফিল ফোডেন ইংল্যান্ড শিবিরে যোগ দেওয়ার পর স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে পূর্ণশক্তির দল নামার দিকেই হাঁটছে ইংল্যান্ড। সব ঠিকঠাক চললে, কোবি মাইনুকে প্রথম থেকে খেলিয়ে দেওয়া হতে পারে। আসলে ইংল্যান্ডকে চলতি ইউরোয় ভোগাচ্ছে মাঝমাঠের ব্যালান্স। ডেকলান রাইসের পাশে তিনি একজন তরুণ মিডফিল্ডার নামাতে চাইছেন, যিনি দলকে প্রয়োজনীয় গতি দেবেন। ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড কিংবা কোনর গালাঘারকে দিয়ে যে কাজ হয়নি। তাই কোবি মাইনুকে স্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে প্রথম একাদশে রাখার ভাবনা চলছে। বুকাও সাকার জায়গাও নড়বড়ে। তাঁর ঘাড়ে ইতিমধ্যেই আর এক তরুণ ফুটবলার কোল পারমার নিঃশ্বাস ফেলা শুরু করে দিয়েছেন। তবে ইংরেজ সমর্থকদের আশ্বস্ত করছেন সাউথগেট। বলে দিচ্ছেন, টিমের গ্রুপ পর্বের ফুটবলের সঙ্গে নকআউট পর্যায়ের ফুটবল মেলাতে যাওয়ার কোনও কারণ নেই। ‘‘এটা সম্পূর্ণ আলাদা একটা পর্ব। সম্পূর্ণ আলাদা একটা চ্যালেঞ্জ। আমাদের খেলাকে পরবর্তী পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস, আমরা সেটা করতে পারব,’’ বলে দিয়েছেন ইংল্যান্ড কোচ।
শুধু করে দেখানোর বিশ্বাস থাকলে চলবে না। সাউথগেটকে করে দেখাতে হবে। না হলে যে এবারও ‘ইটস কামিং হোম’ গানটা গাওয়া যাবে না!
অন্যদিকে যদি প্রশ্ন করা যায়, এবারের ইউরোতে সবথেকে ধারাবাহিক এবং ছন্দবদ্ধ ফুটবল উপহার দিয়েছে কোন দল? এক কথায় উত্তর, স্পেন। গ্রুপ লিগের সবক’টি ম্যাচ তারা জিতেছে। শুধু জেতা নয়, প্রতিটি ম্যাচেই তাদের দাপট ছিল প্রশ্নাতীত। স্পেনের নবীন তারকা লামিনে ইয়ামালের দুরন্ত পারফরম্যান্স চমকে দিয়েছে গোটা ফুটবল বিশ্বকে। তাঁর সঙ্গে রয়েছেন আর এক তরুণ তারকা নিকো উইলিয়ামস। নবীন-প্রবীণের সংমিশ্রণে তৈরি স্প্যানিশ দল এবারের ইউরোতে ফুল ফুটিয়েছে। এবং ইউরোর প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালেও সেই ছন্দ বজায় রাখতে তারা বদ্ধপরিকর। রবিবার শেষ ষোলোর যুদ্ধে তাদের সামনে জর্জিয়া। যারা ইতিমধ্যেই ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো সমৃদ্ধ পর্তুগালকে গ্রুপ লিগের ম্যাচে পরাস্ত করে নকআউটে উঠে এসেছে। ইউরোর ‘কালো ঘোড়া’ জর্জিয়া আরও একবার চমক দেওয়ার জন্য যে প্রস্তুত, তা তারা জানিয়েও দিয়েছে।
ফেভারিট হিসাবে মাঠে নামতে চললেও প্রতিপক্ষকে কোনওভাবেই হালকাভাবে নিচ্ছেন না স্প্যানিশ কোচ ডে লা ফুয়েন্তে। ফুয়েন্তের কোচিংয়ে এই স্প্যানিশ দল অনেকবেশি আক্রমণাত্মক ফুটবল খেলছে। শুধু তাই নয়, তাদের রক্ষণও জমজমাট। এবারের ইউরোতে তারা এখনও কোনও গোল হজম করেনি। পরিসংখ্যানের বিচারের জর্জিয়ার তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে স্পেন। দুই দল এখনও পর্যন্ত সাতবার মুখোমুখি হয়েছে। যেখানে স্পেন জিতেছে ছ’বার। তবু এই পরিসংখ্যানকে মাথাতেই রাখছেন না ফুয়েন্তে। কারণ, পচা শামুকে যে পা কাটে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে কাতার বিশ্বকাপেই। বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে মরোক্কোর কাছে হেরে টুর্নামেন্ট থেকেই ছিটকে গিয়েছিল স্পেন। অতীতের তিক্ত স্মৃতিকে মাথায় রেখেই শেষ ষোলোর যুদ্ধে নামার আগে স্প্যানিশ কোচ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কোনওভাবেই জর্জিয়াকে খাটো করে দেখছেন না। তাঁর বক্তব্য, ‘‘প্রতিপক্ষ হিসাবে জর্জিয়ার যতটা সম্মান প্রাপ্য, তা আমরা দিচ্ছি। মাথায় রাখতে হবে, এবারের প্রতিযোগিতায় ওরা এখনও পর্যন্ত দুরন্ত ফুটবল উপহার দিয়েছে। পর্তুগালের মতো দলকে ওরা হারিয়েছে। ওদের খেলা দেখে যতটুকু ধারণা হয়েছে, তার উপর ভিত্তি করেই বলছি, জর্জিয়া কিন্তু ক্রমাগত উন্নতি করছে।’’ প্রতিপক্ষকে সমীহ করলেও স্প্যানিশ একথাও জানিয়েছেন, তাঁরা পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। তিনি বলেছেন, ‘‘আমরা সতর্ক হয়েই মাঠে নামব। আমাদের পারফরম্যান্সের আরও উন্নতি ঘটাতে হবে। দলের ফুটবলারদের মাথাতেও বিষয়টি রয়েছে। আমাদের লক্ষ্য আরও অনেকদূর যাওয়া। কিন্তু সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে আমাদের আরও উন্নতি প্রয়োজন।’’
[আরও পড়ুন: হজম করতে হয়েছে সমালোচনা, রোহিত-দ্রাবিড়ের ৩ বিতর্কিত সিদ্ধান্তই জেতাল বিশ্বকাপ]
শেষ ষোলোর যুদ্ধে ফুয়েন্তে তাঁর প্রথম একাদশের প্রতিটি ফুটবলারকেই পেতে চলেছেন। গ্রুপের শেষ ম্যাচে প্রথম একাদশের বেশিরভাগ ফুটবলারকেই বিশ্রাম দিয়েছিলেন স্প্যানিশ কোচ। জর্জিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে দলে ফিরছেন রড্রি। সদ্যই রিয়াল মাদ্রিদ থেকে বিদায় নেওয়া নাচোর ফিটনেসজনিত সমস্যা ছিল। এছাড়া ফিটনেস সমস্যায় ভুগছিলেন পেরেজ। এই দু’জনই সম্ভবত দলে ফিরতে চলেছেন। এছাড়া দলে আর কোনও চোট আঘাতের খবর নেই। তবে দানি ওলমোকে সম্ভবত রিজার্ভ বেঞ্চেই রাখতে চলেছেন কোচ। ফরোয়ার্ড লাইনে অধিনায়ক আলভারো মোরাতাকে সহযোগিতা করবেন দুই তরুণ তারকা নিকো উইলিয়ামস এবং ইয়ামাল। দলের বর্ষীয়ান তারকা ফেরান তোরেস নবীন সতীর্থ ইয়ামাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘ইয়ামাল স্বপ্নের ফর্মে রয়েছে। আমাদের দলে প্রতিযোগিতা আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। আমরা সবাই খেলতে চাই।’’ শুধু তোরেস নন, ইয়ামাল সম্পর্কে উচ্ছ্বসিত প্রাক্তন স্প্যানিশ তারকা দাভিদ ভিয়া। তিনি জানিয়েছেন, ‘‘ইয়ামাল দুর্দান্ত। আমাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ ফুটবলার। মাত্র ১৬ বছরেই যেভাবে পারফর্ম করছে, তা অনন্য। তবে কোনওভাবেই ওর উপর চাপ তৈরি করা উচিত হবে না। ও
খুবই ছোট।’’
দেখার জর্জিয়ার বিরুদ্ধেও ফুল ফোটাতে পারেন কিনা ইয়ামাল।