দেব গোস্বামী, বোলপুর: ব্যবসা সংক্রান্ত ঝামেলায় বিশ্বভারতীর মায়ানমারের ছাত্র অপহরণের ঘটনা স্পষ্ট হওয়ার পর এবার পুলিশ সেই কারবারের মূলে ঢুকতে চায়। বুঝতে চায়, কতখানি নিয়ম মেনে চলছিল সেই কারবার। পুলিশের দাবি, বিধি মেনে সবকিছু চলছিল না বলে এই অপহরণ। শান্তিনিকেতনের ভাড়াবাড়ি থেকে ওই ছাত্রকে অপহরণের ঘটনায় ধৃতদের ১২ জনের মধ্যে তিন জনকে শনিবারই আদালতে তোলা হয়। বাকি ৯ জনকে রবিবার বিশেষ আদালতে তোলা হয়। তাঁদেরও ১৪ দিনের জন্য জেল হেফাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়।
আদালতে ধৃতরা জানায়, প্রত্যেকেই মানুষের চুলের ব্যবসা করতেন। সেই ব্যবসার সঙ্গেই যুক্ত হন মায়ানমারের এই ছাত্রটি। ধৃতদের কাছ থেকে মোট ৬০ লক্ষ টাকা নিয়েছিল ছাত্রটি। তার মধ্যে ৯ লক্ষ টাকা ফেরত দেয়। বাকি ৫১ লক্ষ টাকার হিসাব বোঝাপড়ার জন্যই এই অপহরণ। আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের যোগও আরও স্পষ্ট হয়েছে এই অপহরণের পিছনে। অপহৃত ছাত্রটি যে সেই অবৈধ কারবারেরও সঙ্গী ছিলেন, আদালতে সেকথাই জানিয়েছে ধৃতরা। তবে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এদেশের ভিসা নিয়ে থাকা মায়ানমার থেকে পড়তে আসা ওই পড়ুয়া কীভাবে বেআইনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হলেন।
[আরও পড়ুন: বিদেশ থেকে ফিরেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা, এসএসকেএম হাসপাতালে মুখ্যমন্ত্রী]
যদিও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রথমে বোলপুর সংশোধনাগারে ওই ছাত্রকে নিয়ে গিয়ে শনাক্তকরণ করানো হবে। তারপরই শুরু হবে জিজ্ঞাসাবাদ পর্ব। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাভবনে তুলনামূলক ধর্ম ও দর্শন বিভাগে সংস্কৃত বিষয়ে গবেষণারত ওই ছাত্র। মায়ানমার থেকে ১০ বছর আগেই শান্তিনিকেতনে আসেন। ছাত্রের নাম প্যানচারা থাই। ২০২২ সালে গবেষণার থিসিসপত্র জমা দিয়েছিলেন তিনি। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তাঁর ভিসার মেয়াদ রয়েছে এদেশে। হস্টেল না পাওয়ায় ইন্দিরাপল্লি বোলপুর পুরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডে একটি ভাড়াবাড়িতে থেকেই তিনি পড়াশোনা করতেন। হঠাৎই বৃহস্পতিবার ভরদুপুর দুটোর সময় ভাড়াবাড়িতে চড়াও হয় এবং ওই পড়ুয়াকে কালো গাড়িতে চাপিয়ে চম্পট দেয় অপহরণকারীরা। বিষয়টি জানাজানি হতেই শান্তিনিকেতনে চাঞ্চল্য ছড়ায়।
ঘটনার পর বৃহস্পতিবার রাতে বিদেশি ছাত্রকে অপহরণ করা হয়েছে বলে বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষকে জানান ওই ছাত্রের এক সহপাঠী। সেই মতোই বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের তরফেও ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার তড়িঘড়ি অভিযোগ জানান বোলপুর থানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের অন্দরে শোরগোল পড়ে যায়। আন্তর্জাতিক ছাত্র হওয়ার কারণেই অভিযোগ পাওয়ার পরই শুক্রবার সকাল থেকেই পুলিশ প্রশাসনও নড়েচড়ে বসে। অপহরণের মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করে বোলপুর থানার পুলিশ। প্রোটোকল অনুযায়ী দূতাবাসকেও জানানো হয়। জল গড়ায় নবান্ন পর্যন্ত। পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়। অবশেষে ৩০ ঘণ্টা খোঁজাখুঁজির পর শুক্রবার রাতে ওড়িশার তালসারি ব্রিজ থেকে উদ্ধার করা হয় নিখোঁজ বিদেশি গবেষক ছাত্রকে। প্রায় ১০ বছর ধরেই বিদেশি ছাত্র রয়েছেন শান্তিনিকেতনের ভাড়াবাড়িতে। আপাত নিরীহ বিদেশি ছাত্রের ‘কারবার’-এর কথা ঘুণাক্ষরেও টের পাননি কেউই।
পাড়া প্রতিবেশী তো দূরে থাক, খোদ বাড়িওয়ালারাও কি পেলেন না সামান্য টের। কোটি কোটি টাকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক চক্রের পাণ্ডা হিসাবে মায়ানমারের ছাত্রের নাম সামনে আসায় উদ্বেগ ছড়িয়েছে সকলের মধ্যেই। ভরদুপুরে আচমকা এক গবেষক ছাত্রকে দশ-বারো জনের দল এসে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় চোখ খোলে অনেকের। তদন্তে একের পর এক উঠে আসা তথ্য চমকে দিয়েছে সবাইকে। আপাতত সেই ছাত্রকে ওড়িশা থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ১২ জন অপহরণকারীকে গ্রেপ্তার করেছে। কিন্তু এনিয়ে চিন্তিত সকলেই। একাংশের মত, প্রায় সাড়ে ছয় হাজার পড়ুয়া রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। যদি এমন ঘটনা ঘটতে থাকে তা হলে সত্যিই তা উদ্বেগের।