সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ব্যাট-প্যাড তুলে রাখলেন হরভজন সিং। শুক্রবার টুইটে লিখলেন, ”সব ভাল জিনিসেরই একদিন শেষ হয়। যে খেলাটা আমাকে সব দিয়েছে জীবনে, সেই খেলাটাকেই আমি আজ বিদায় জানালাম।” ক্রিকেটমাঠের সবুজ গালচে থেকে পাঞ্জাবতনয়ের বিদায়-ঘোষণা স্মৃতিমেদুর করে তুলছে তাঁর একসময়ের সতীর্থদের, ক্রিকেটপ্রেমীদের। ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে উঠছে ভাজ্জির বর্ণময় ক্রিকেট জীবন। সেই জীবন প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার সৌরাশিস লাহিড়ি। হরভজন ও সৌরাশিস দু’জনেই সমসাময়িক। পাঞ্জাবতনয়ের মতোই তিনিও অফস্পিনার। ভাজ্জির উত্থান খুব কাছ থেকে দেখেছেন। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে সৌরাশিস বললেন, ”একটা যুগ শেষ হয়ে গেল। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় যে টিম ইন্ডিয়া তৈরি করেছিলেন, সেই টিম দেশকে এনে দিয়েছে অনেক সাফল্য, জন্ম দিয়েছে অনেক গর্বের মুহূর্ত। সেই দলের অন্যতম কাণ্ডারী ছিল হরভজন।”
শুরু দেখে বোঝা যায় দিনটা কেমন যাবে। হরভজনও শুরুর দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, তিনি লম্বা রেসের ঘোড়া। ১৯৯৮ সালে শারজায় অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওয়ানডে-তে রিকি পন্টিংকে বোকা বানিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরিয়েছিলেন হরভজন।পন্টিং ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে মারতে গিয়েছিলেন ভারতের অফস্পিনারকে। কিন্তু হরভজনের বুদ্ধিদীপ্ত ডেলিভারিতে ঠকে যান অজি-তারকা। বল হাতে পৌঁছতেই উইকেট ভেঙে দেন নয়ন মোঙ্গিয়া। উইকেট পাওয়ার আনন্দে উচ্ছ্বসিত পাঞ্জাবতনয়ের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল পন্টিংয়ের। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে সৌরাশিস ফিরে যাচ্ছেন মরুশহরের সেই ম্যাচে। বলছেন, ”খুব মনে আছে সেই ম্যাচ। পন্টিংয়ের মতো একজন তারকাকে যে ভাবে আউট করেছিল, তাতে সবাই বুঝতে পেরে গিয়েছিল এসে গিয়েছে চ্যাম্পিয়ন।আর পন্টিংকে যে সেন্ড অফটা দিয়েছিল সেটাও আমার বেশ মনে রয়েছে।” মাঠের ভিতরে দু’জনের লড়াই নিয়ে পরবর্তীকালে অনেক কালি খরচ হয়েছিল সংবাদমাধ্যমে।
[আরও পড়ুন: খুল্লামখুল্লা প্রেম! পার্ক স্ট্রিটের রাস্তায় বান্ধবী কিম শর্মাকে চুমু লিয়েন্ডারের, ছবি ভাইরাল]
তার পরে দিন যত এগিয়েছে, হরভজন ততই আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর লড়াকু মানসিকতা বারবার ফুটে উঠেছে মাঠে। চোখে চোখ রেখে লড়াই করে গিয়েছেন প্রবল প্রতিপক্ষের সঙ্গে। হার না মানা এই হরভজনকেই তো চেনেন বাংলার অফস্পিনার। সৌরাশিস তাই বলছেন, ”সিংহহৃদয় একজন ক্রিকেটার হরভজন। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে যেত। একশব্দে হরভজন সিংকে কিছুতেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।”
২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ইডেন টেস্টে ভিভিএস লক্ষ্মণ ও রাহুল দ্রাবিড়ের মহাকাব্যিক পার্টনারশিপ এখনও অনেক ক্রিকেটপাগলের রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয়। ইডেনের প্রতিটি ঘাস আজও মনে রেখেছে ভাজ্জির হ্যাটট্রিক। প্রথম ভারতীয় বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে হ্যাটট্রিক করার নজির গড়েছিলেন তিনি। সেই স্মৃতিতে ডুব দিয়ে সৌরাশিস বলছেন, ”যদি একটা ম্যাচের কথা বলতে বলা হয় আমাকে, তাহলে ইডেনে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিকটার কথাই আমি বলব।”
ইডেনের হ্যাটট্রিক বিখ্যাত করে দিয়েছিল হরভজনকে। আবার অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ‘মাঙ্কিগেট’ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে এক বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন পাঞ্জাবতনয়।পিছন ফিরে তাকিয়ে সৌরাশিস বলছেন, ”খুব আগ্রাসী ক্রিকেটার। সেই কারণেই মাঠের ভিতরে জড়িয়ে পড়ত নানা ঘটনায়। কখনও সাইমন্ডসের সঙ্গে, কখনও শ্রীসন্থ। তবে দীর্ঘ ক্রিকেটজীবনে এমনটা তো হতেই পারে। সাদা-কালো নয়, রঙিন একটা চরিত্র। এই কারণেই তো হরভজন সিংকে নিয়ে এত কথা হচ্ছে।”
এই তো এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মহারণের বহু আগে ‘বন্ধু’ শোয়েব আখতারকে টীপ্পনী কেটে বলেছিলেন, ”খেলে কী হবে? তার বদলে তোমরা ওয়াকওভার দাও।” মরুশহরে ভারতকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে উড়িয়ে দেওয়ার পরে পালটা দিয়েছিলেন ‘রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস’ও। নেহাতই বন্ধুত্বপূর্ণ খুনসুটি। কিন্তু শ্রীলঙ্কায় ২০১০ সালের এশিয়া কাপে এই দুই তারকার মধ্যেই তো লেগে গিয়েছিল মাঠে। শোয়েবকে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন হরভজন। কথিত আছে, পরে শোয়েব নাকি ভারতীয়দের হোটেলে এসে খুঁজেছিলেন ভাজ্জিকে। সেই ম্যাচ নিয়ে সৌরাশিস বলছেন, ”শোয়েব আখতারের মতো ওরকম একজন ত্রাসসৃষ্টিকারী বোলার আর তাঁকেই কিনা ছক্কা মেরে দিল। এটাই তো ভাজ্জি। যত পরিণত হয়েছে ততই কনট্রিবিউটার হয়ে উঠেছিল। নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে দুটো সেঞ্চুরি করেছিল। শুধু বল হাতে উইকেট নিয়ে নয়, বরং ব্যাট হাতেও নির্ভরতা দিয়েছিল দলকে।”
[আরও পড়ুন: 83 Movie: মুক্তির দিনই সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘৮৩’ ছবি বয়কটের ডাক, কিন্তু কেন?]
এহেন হরভজনের সঙ্গে একসময়ে একই নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হত সাকলিন মুস্তাক ও মুথাইয়া মুরলীধরনের নামও। তিন জনই কিংবদন্তি অফস্পিনার। নস্ট্যালজিক সৌরাশিস বলছেন, ”সেই সময়ে যাঁরা এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখেছেন, তাঁরা ভীষণ ভাগ্যবান। আজকের টেনিস বিশ্বে ফেডেরার, নাদাল ও জোকোভিচের মধ্যে ত্রিমুখী লড়াই দেখা যায়। ঠিক তেমনই সেই সময়ে এই তিন দুর্দান্ত স্পিনারের মধ্যে লড়াই হত।”
ভাজ্জিকে মহীরূহ হয়ে উঠতে দেখেছেন বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার। তিনি বলছেন, ”আমরা দু’ জনেই অফস্পিনার। ভাজ্জিকে দেখে সব সময়ে মনে হত, ও আমাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। ওর বলের পাঞ্চ, বাউন্স, গতি এবং বৈচিত্র্য বাকিদের থেকে ওকে অনেকটাই এগিয়ে রেখেছিল। যত দিন এগিয়েছে, ততই অস্ত্রগুলোকে শাণিত করেছে।” পরিণত হরভজন টেস্টে তুলে নিয়েছেন ৪১৭টি উইকেট। ওয়ানডে-তে ২৬৯টি উইকেটের মালিক তিনি।
কিন্তু এরকম একজন ক্রিকেটারের শেষটা তো রূপকথার হল না। পাঁচ বছর আগে টি-টোয়েন্টিতে শেষবার জাতীয় দলের জার্সিতে দেখা গিয়েছিল ভাজ্জিকে। আরও একটু ভাল ভাবে কি শেষ হতে পারত না হরভজনের কেরিয়ার? সৌরাশিস বলছেন, ”সবার ক্রিকেট কেরিয়ার তো রূপকথার মতো শেষ হয় না। ক্রিকেট মাঠে ভাজ্জির সাফল্য কোনওদিনই মুছে ফেলা যাবে না। সবার স্মৃতিতে থেকে যাবে হরভজন সিং।”