সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: প্রয়াত জম্মু-কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগমোহন। সোমবার দিল্লিতে ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। এমনটাই খবর সংবাদ সংস্থা এএনআই সূত্রে।
[আরও পড়ুন: করোনা কালেও প্রধানমন্ত্রীর নয়া বাসভবন তৈরির কাজ চালু, মিলল পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্রও]
প্রাক্তন এই আমলার প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। নিজের টুইটার হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন, “জগমোহনজির মৃত্যুতে দেশের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ প্রশাসক ও বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। সবসময় দেশের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে কাজ করতেন জগমোহনজি। আমি তাঁর পরিবার ও গুণগ্রাহীদের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি।” উল্লেখ্য, ১৯২৭ সালে জন্ম হয় জগমোহনের। কাশ্মীরের পাশাপাশি দিল্লি ও গোয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নরের দায়িত্ব সমলেছেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৬ জনুয়ারি ‘দিল্লি মাস্টার প্ল্যান’-এর জন্য তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়।
প্রশাসনিক স্তরে অত্যন্ত দক্ষ এই দুঁদে আমলা জম্মু-কাশ্মীরের এক কালো অধ্যায়ের সাক্ষী থেকেছেন। ১৯৯০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জেরে স্বভূমি থেকে চলে আসতে হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের। তিনি রাজ্যপাল থাকাকালীন ভূস্বর্গে কাশ্মীরি পণ্ডিতদের যে হত্যালীলা চলে তার স্মৃতি আজও টাটকা। ১৯৮২ সালে মৃত্যু হয় শেখ আবদুল্লার। তারপর ন্যাশনাল কনফারেন্সের রাশ ধরেন তাঁর পুত্র ফারুক আবদুল্লা। ১৯৮৩ সালের ভোটে জেতেন ফারুক। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই কেন্দ্রের সঙ্গে ন্যাশনাল কনফারেন্সের বিচ্ছেদ ঘটে। কেন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী পদে বহাল করে বিক্ষুব্ধ নেতা গুলাম মহম্মদ শাহকে। ইয়াসিন মালিকের নেতৃত্বে জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট (জেকেএলএফ)-এর সক্রিয়তা বাড়তে থাকে। ১৯৮৪ সালে সন্ত্রাসবাদী মকবুল ভাটের ফাঁসি উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তারপর ১৯৮৬ সালে রাজীব গান্ধী সরকার বাবরি মসজিদের দরজা হিন্দুদের জন্য খুলে দেয়, যার জের পৌঁছয় কাশ্মীরেও।
এদিকে, ১৯৮৬ সালে মহম্মদ শাহ সরকারের বিরুদ্ধে জনরোষ তৈরি হতেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ফের ফারুক আবদুল্লার উপর ভরসা করেন। তাঁকে আবার মুখ্যমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৭ সালের বিতর্কের মাঝেও ভোটে জিতে ফারুক সরকার তৈরি করেন। এরপরেই জঙ্গিরা অতিসক্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯৮৯ সালে জেকেএলএফ মুফতি মহম্মদ সইদের মেয়েকে অপহরণ করলে পরিস্থিতি জটিল আকার নেয়। ততদিনে পণ্ডিতদের উপর হামলা শুরু হয়ে গিয়েছে। ১৩ সেপ্টেম্বর খুন হন উপত্যকার বিজেপি নেতা টিকালাল টাপলো। মকবুল ভাটের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন যে বিচারপতি, নীলকণ্ঠ গাঞ্জু, জম্মু-কাশ্মীর হাই কোর্টের বাইরে তাঁকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাংবাদিক তথা আইনজীবী প্রেমনাথ ভাট ২৭ ডিসেম্বর অনন্তনাগে খুন হন। পণ্ডিতদের হিট লিস্ট তখন জঙ্গিদের হাতে ঘুরছে। গোটা সম্প্রদায়ের মধ্যে সন্ত্রাসের আবহ। এরই মধ্যে একটি স্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল একটি বার্তা, নামহীন। সেখানে পণ্ডিতদের উপত্যকা ছাড়তে বলা হল। অভিযোগ, এ বার্তা হিজবুল মুজাহিদিনের। ১৯ জানুয়ারির রাতে আর কোনও আড়াল রইল না। ততদিনে ফারুক আবদুল্লা সরকারকে বরখাস্ত করে লাগু হয়েছে রাজ্যপালের শাসন। বেশ কিছু পরিচিত কাশ্মীরি পণ্ডিতদের বয়ান, মসজিদের লাউডস্পিকার থেকে ভেসে আসছিল হুমকি, রাস্তায় রাস্তায়ও একই পরিস্থিতি। পাকিস্তান ও ইসলামের গুণগান করে সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেওয়া হচ্ছিল। সে ভাষণে বিরোধিতা করা হচ্ছিল হিন্দুত্বের।
এহেন পরিস্থিতিতে ১৯ জানুয়ারি শ্রীনগর পৌঁছন জগমোহন। কাশ্মীরি মুসলিমদের একাংশের অভিযোগ, পণ্ডিতদের ঘর ছাড়ার ব্যাপারে তিনি উৎসাহ দিয়েছিলেন। যার জেরে কাশ্মীর ইস্যু সাম্প্রদায়িক মাত্রা পায়। যদিও কাশ্মীরি হিন্দুদের মতে, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। তাঁরা পালটা জানান, যে কাশ্মীরি মুসলিমদের সঙ্গে তাঁরা কয়েক শতক ধরে একসঙ্গে বাস করে এসেছেন, তারাই ধর্মীয় উন্মাদনায় মেতে উঠে পণ্ডিতদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করেন। যে পরিস্থিতির কথা কয়েক মাস আগেও ভাবা যেত না। সব মিলিয়ে ভারতীয় ইতিহাসের অন্যতম কালো অধ্যায়ের সাক্ষী থেকেছেন জগমোহন। তাঁর মৃত্যুতে অনেক প্রশ্নেরই উত্তর আর হয়তো কোনওদিনও মিলবে না।