অপরাজিতা সেন: রাজভবনকে কেন্দ্র করে জট আরও জটিল হচ্ছে। মঙ্গলবারের ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এ ভিন রাজ্যের আমলাদের নিয়ে রাজ্যপালের পরামর্শদাতা নিয়োগের বৃহত্তর প্লট প্রকাশ হতেই দিল্লি ও কলকাতার প্রশাসনিকমহলে চাঞ্চল্য তীব্র হয়েছে।
এদিন রাজভবনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস ও তাঁর প্রধান সচিব নন্দিনী চক্রবর্তী অফিস করলেও, নিজেদের মধ্যে কোনও বাক্য বিনিময় করেননি। দিল্লি সূত্রে খবর, রাজ্যপালের নিযুক্ত তিন পরামর্শদাতা, প্রাক্তন সিবিআই অধিকর্তা রাকেশ আস্থানা (Rakesh Asthana), কেরলের আইএএস অফিসার রবি মেনন (Ravi Menon) এবং তামিলনাড়ুর প্রাক্তন আমলা এম শীলা প্রিয়া, রাজভবনে আসার প্রস্তুতি শুরু করেছেন। এই তিন উপদেষ্টার দপ্তর তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার ঘনিষ্ঠ আমলা শীলা রাজভবনে এসে সি ভি আনন্দ বোসের অতিথি হিসেবে চারদিন কাটিয়ে গিয়েছেন। তিনি রাজভবনের আধিকারিকদের ক্লাসও নিয়েছেন। জয়ললিতা যখন গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে তখন শীলা কার্যত তামিলনাড়ুর সরকার চালাতেন। রাজভবনের ক্লাসে শীলা বুঝিয়েছেন কীভাবে তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার (J Jayalalita) মডেলে সরকার চলত। তামিলনাড়ুর প্রাক্তন আমলার নানা পরামর্শ পছন্দ হয়নি রাজভবনে কর্মরত রাজ্যের আধিকারিকদের। রাজ্য সরকারকে অন্ধকারে রেখে সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা মানছেন না কেউই। পরামর্শদাতারা এলে নন্দিনী আদৌ রাজভবনে থাকবেন কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। নন্দিনীকে যদি সরতেই হয়, তাহলে সেটা কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও চলছে জল্পনা। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল হয়ে উঠছে।
[আরও পড়ুন: সংবাদমাধ্যমকে ভয় দেখানো ও হেনস্তার চেষ্টা চলছে, BBC দপ্তরে আয়কর ‘হানা’ নিয়ে উদ্বিগ্ন এডিটর্স গিল্ড]
নন্দিনীর নিয়োগকর্তা মুখ্যসচিব। যতক্ষণ না তিনি সরাচ্ছেন ততক্ষণ নন্দিনী রাজ্যপালের প্রধান সচিব হিসেবেই কাজ করবেন। নন্দিনী থাকবেন কি না, এই প্রশ্নে রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে দ্রুত একটি সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যদিও সরকারিভাবে এখন দু’পক্ষের মধ্যে চলছে ভয়ংকর নীরবতা। রাজ্যপাল অত্যন্ত গোপনে তিনজন পরামর্শদাতার নিয়োগপর্ব সেরে ফেলেছেন। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রতিবেদনেই প্রকাশিত হয়েছে কীভাবে রাজ্য সরকারকে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে সি ভি আনন্দ বোস (CV Ananda Bose) এই কাজ করছেন। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর প্রতিবেদন নিয়ে কোনও আপত্তি মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত রাজভবন থেকে করা হয়নি।
নন্দিনীকে প্রধান সচিব পদে রেখে রাজ্যপালের পক্ষে এই পরামর্শদাতা নিয়োগের কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না বলেই তিনি তাঁকে সরাতে আগ্রহী। রাজ্য সরকারের প্রবীণ আমলা নন্দিনী বিধি মেনে কাজ করার বিষয়ে খুবই কঠোর। সে কারণে রাজ্য সরকারকে না জানিয়ে রাজভবনের কোনও কাজে সম্মতি দিতে তিনি রাজি নন। পরামর্শদাতার নিয়োগসংক্রান্ত ফাইলেও তিনি সম্মতি দেননি। নন্দিনী যে রাজ্যপালের এই সমান্তরাল প্রশাসন তৈরি করার চেষ্টাকে কোনওভাবেই বরদাস্ত করতে পারছেন না, সেটা বুঝতে পারছে রাজ্য সরকারও। সে কারণে রাজ্য সরকারও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে রাজ্যপাল ও নন্দিনীর এই সংঘাতের দিকে নজর রাখছে।
দিল্লি সূত্রে খবর, রাজ্যপাল না কি একটি মেসেজ করে রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদীকে বলেছেন, নন্দিনীকে রাজভবন (Raj Bhaban) থেকে অব্যাহতি দিতে চান। কিন্তু, মুখ্যসচিব রাজ্যপালের নির্দেশে কাজ করতে বাধ্য নন। বিধি অনুযায়ী মুখ্যসচিব চলেন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। সাধারণত, রাজ্য সরকার কয়েকজন আধিকারিকের নাম রাজ্যপালের কাছে পাঠায়। রাজ্যপাল সেখান থেকে তাঁর পছন্দের অফিসারকে সচিব হিসেবে বেছে নিতে পারেন। কিন্তু, রাজ্যপালের ইচ্ছায় কাউকে রাজভবন থেকে এইভাবে তুলে নেওয়া হবে কি না, সেই প্রশ্নে বিরোধ হচ্ছে। রাজ্যপাল ও রাজ্য সরকার দু’পক্ষই কার্যত রুলবুক নিয়ে ঘুরছে। নন্দিনীর পক্ষে এইভাবে রাজভবনে কাজ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে বলে প্রশাসনের একটি সূত্রের মত। মঙ্গলবার দিল্লি থেকে ফিরে সারাদিন রাজভবনে দপ্তর করেছেন রাজ্যপাল। নন্দিনীও অন্যান্য দিনের মতোই সারাদিন রাজভবনের দপ্তরে কাজ করেছেন। কিন্তু, একবারেরও জন্যও রাজ্যপাল ও নন্দিনী মুখোমুখি হননি। তাঁদের মধ্যে একটি বাক্যও বিনিময় হয়নি। রাজ্যপালের এই সমান্তরাল প্রশাসন তৈরির কাজে বিজেপির ভূমিকাও খতিয়ে দেখছে রাজ্য।
[আরও পড়ুন: দেশের শিল্পপতিরা বিজেপির পাশেই! অনুদানের অঙ্কে বাকিদের থেকে বহু এগিয়ে গেরুয়া শিবির]
রাজভবন ও সরকারের এই সংঘাতে বিজেপির সঙ্গে উৎসাহী দেখাচ্ছে সিপিএম (CPIM) ও কংগ্রেসকেও (Congress)। তৃণমূল গোটা ঘটনায় অবাক হচ্ছে না। তৃণমূলের মত, ধনকড়ের মতোই বর্তমান রাজ্যপালেরও উৎস এক। ফলে বর্তমান রাজ্যপাল যতক্ষণ বাস্তবমুখী কাজ করছেন ততক্ষণ তাঁকে স্বাগত। কিন্তু, তিনি যদি পরামর্শদাতা নিয়োগের নামে রাজ্যের উপর নজরদারির চেষ্টা চালান, সমান্তরাল প্রশাসন চালানোর চেষ্টা করেন বা অন্য রাজ্যের আমলাদের এনে বৃহত্তর চক্রান্ত করেন তাহলে তৃণমূলও (TMC) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধাপে ধাপে প্রতিক্রিয়ার ভাষা এবং মেজাজ দুটোই বদলাবে।