চারুবাক: ছবির প্রধান চরিত্র অভিমন্যুর মতোই কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের নতুন ছবি ‘গুডনাইট সিটি’। জটিল তো বটেই, সাধারণ দর্শকের কাছে জটিলতর মনেও হতে পারে। পরিচালক নিজে পেশায় একদা ডাক্তার ছিলেন- হয়তো সেজন্যই একজন মনোরোগীর মানসিক অন্দিসন্ধিগুলোর খোঁজখবর তিনি জানেন। কিন্তু দর্শকের কাছে সেই গলিখুঁজির সুলুকসন্ধান দিতে হলে সিনেমার ভাষায় মানসিক ঘাত-প্রতিঘাত-সংঘাতগুলোকে সিনেমাটিক ইমেজে বাঁধা দরকার। এই ছবিতে সেই বাঁধুনির অভাব।
[ কেমন হল পরি পিসি ও ঘোঁতনের ‘রেনবো জেলি’র স্বাদ? ]
মাত্র একটি রাতের গল্প। একটি ফোন। তার দু’প্রান্তে তিনটি মানুষ। একপ্রান্তে মনের রোগী অভিমন্যু (ঋত্বিক)। অন্যপ্রান্তে সাইক্রিয়াটিস্ট আভেরি (ঋতুপর্ণা) আর তার গোয়েন্দা অফিসার স্বামী ঋষি (শাশ্বত)। টিভিতে আভেরির টক-শো দেখার কয়েক মিনিট পরেই আত্মহত্যায় উদ্যত অভিমন্যু বারবার তাকে ফোন করে নিজের জীবনকাহিনি বলে চলে। অন্যপ্রান্তে আভেরি শুধু ধৈর্য ধরে তার কথা শোনেই না, তাকে মানসিক সঙ্গও দেয়। স্বামী ঋষি লালবাজারের গোয়েন্দা বাহিনীর সাহায্য নিয়ে অভিমন্যু-সহ তার সাত শত্রুর হদিশ জানতে পুরো শহর রাতজুড়ে তোলপাড় করে চলে। অভিমন্যুর মানসিক রোগের কারণ তার অবদমিত বাল্যকাল, উঠতি বয়সে যৌনবিকার এবং সেই কারণেই পরবর্তী সময় হিংসা, ঘৃণা, প্রতিশোধ এবং আত্মধ্বংসের ইচ্ছা। আভেরি তার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে বলেই ধৈর্য ধরে সারারাত কথা বলে চলে। কিন্তু দর্শকের কাছে সেটা যে বিরক্তির কারণ হবে, সেটা বোঝেননি পরিচালক। যদিও ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়া আসার ব্যাপারটি কমলেশ্বর যুক্তি মেনেই করেছেন। এখানে স্ট্রাকচারটি লিনিয়ার। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। রাতের শেষে, ভোরে সবাই বাড়িতে জড়ো হলে অভিমন্যুর চুলদাড়ির জঙ্গল নিয়ে প্রবেশ করাটা অপ্রত্যাশিত লাগবে। কারণ, সারারাত বিচ্ছিরি রকমের পরচুলা পরা অভিমন্যুটি তাহলে কে- অতীত না বর্তমানের? এর উত্তর পরিচালক কী দেবেন?
[ দর্শক টানতে নাটুকে মশলায় পরিপূর্ণ শিবপ্রসাদ-নন্দিতার ‘হামি’ ]
অভিমন্যুর সাত শত্রুর মতো এখানেও মধুমিতা (অরুণিমা), বাপি (সৌরভ), বাবা (সুদীপ), জিয়া (পায়েল), বন্ধু (সায়নী), ম্যানেজার সান্যাল (পদ্মনাভ)-রা রয়েছেন। তাঁরাই যেন অভিমন্যুকে ঘিরে চক্রব্যূহ রচনা করেন। এই ভাবনাটি ভাল। ছবির বিন্যাসে কমলেশ্বর যে জটিলতার পরিবেশটি রচনা করেন, তার সঙ্গে অভিমন্যুর মানসিকতার একধরনের প্যারালাল টানার চেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু সাধারণ দর্শকের কাছে সেটা কতটা গ্রহণীয় হবে, বলা মুশকিল। ‘গুডনাইট সিটি’-র নির্মাণ কৌশল ও শৈলীর মধ্যে যেন পরিচালকের আত্মসন্তুষ্টির প্রশ্রয়টাই বেশি, দর্শকগ্রাহ্যতা কম। তিনি একইসঙ্গে বুঝিয়ে দিলেন তাঁর আস্তিনে লুকোনো আছে এখনও কিছু রহস্য। যা সাধারণ দর্শকের কাছে সহজপাচ্য নাও হতে পারে।
মূল চরিত্র এক সাইকোপ্যাথ বলেই ছবির সেট পরিকল্পনায় এক ধরনের ক্যুইয়ার এলিমেন্ট রেখেছেন পরিচালক। দেবজ্যোতি মিশ্রর আবহ সৃজনে এবং গানের সুরেও সাইকোডেলিক ভাবনার ছাপ স্পষ্ট। অভিনয়ে, প্রধান চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী অবশ্যই অভিমন্যুর মতোই ছটফটানি বজায় রেখেছেন। তবে তাঁকে আরও ভাল ব্যবহার করা যেত ফোটোগ্রাফিক্যালি। মনোবিদ ঋতুপর্ণা ও গোয়েন্দা চরিত্রে শাশ্বত শুধুই স্বাভাবিক। অরুণিমা ঘোষ, পায়েল সরকার, সুদীপ মুখোপাধ্যায়, সৌরভ দাসদের চিত্রনাট্যের বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তাঁরা যানওনি। আসলে ‘গুডনাইট সিটি’ পরিচালক কমলেশ্বর ও অভিনেতা ঋত্বিকের ছবি। তাঁরা দু’জনেই একে অপরকে পেরিয়ে যেতে চেয়েছেন, পেরেওছেন। তবে কে কাকে, বলা মুশকিল।
The post ঋত্বিক-ঋতুপর্ণা-শাশ্বত ত্রয়ীর পারফরম্যান্সে কেমন হল ‘গুডনাইট সিটি’? appeared first on Sangbad Pratidin.