তনুজিৎ দাস: জ্ঞানের কোনও আবরণ হয় না। তবু জ্ঞানের উৎসকে সযত্নে রাখা জ্ঞানপিপাসুর আজন্ম অভ্যাস। সেই অভ্যাসকেই যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্বে চালিত করেছেন ‘মলাটদাদু’। যাঁর দেখা মেলে প্রতিবছর, বইমেলায়। নতুন ছাপার গন্ধমাখা বই হোক কিম্বা পাতা ঝরঝরে হয়ে যাওয়া পুরনো গ্রন্থ – সযত্নে তার আবরণ তৈরি করে দেন গোপেশ্বর চক্রবর্তী। তাঁর এই নিরলস শ্রমের কাছে হার মেনে যায় পিডিএফ সংস্করণ, ই-বুক।
সোশ্যাল মিডিয়ার যুগেও যে প্রচ্ছদে, পাতায়, অক্ষরে, বর্ণে সুসজ্জিত বই স্বমহিমায় বেঁচে আছে, তা হয়তো বারবার প্রমাণ করে কলকাতা বইমেলার উপচে পড়া ভিড়। শুরু থেকে শেষ – এই স্টল, ওই স্টল ঘুরে ঘুরে ব্যাগবন্দি করতে মরিয়া বইপ্রেমীরা। আর বইপ্রেমীদের সেই বইকে সুন্দর রাখতে বরাবরের মতোই এবারের বইমেলাতেও হাজির গোপেশ্বর চক্রবর্তী। যাঁর পেশা বইয়ে মলাট দেওয়া৷ মেলায় ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়বে, এক কোণা জায়গায় বই ও মলাট নিয়ে বসে রয়েছেন তিনি। বইয়ের আবরণ তৈরি করার অধীর অপেক্ষায়।
[সিবিআইয়ের প্রাক্তন ডিরেক্টর নাগেশ্বর রাওয়ের স্ত্রীর সংস্থায় তল্লাশি কলকাতা পুলিশের]
গোপেশ্বর বাবুর কথায়, বইকে সযত্নে রাখা তাঁর নেশা। আর এই নেশা তাঁর মনে জাগিয়েছিলেন তাঁরই গুরু পতিতপাবন গড়াই। সেই নেশাকেই পরবর্তী সময়ে পেশা করেছেন গোপেশ্বরবাবু। ১৯৭৩-৭৪ সাল থেকে তিনি শুরু করেছেন বই মলাট দেওয়ার কাজ। কলেজ স্ট্রিটের বইপাড়া থেকে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, একাধিক বইমেলা ঘুরে আজও তা বর্তমান সল্টলেক সেন্ট্রাল পার্কে৷ কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলার শুরু থেকেই তিনি এর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী। এ বছর অনুষ্ঠিত ৪৩তম কলকাতা বইমেলাতেও একই ভূমিকায় রয়েছেন এই মানুষটি৷ দুপুর থেকে সন্ধে, তাঁকে ঘিরে থাকেন বইপ্রেমীরা। সকলের একটাই চাহিদা, নিজের অতি প্রিয় বইটাকে সুন্দর করে বাঁধিয়ে নেওয়া৷ প্রত্যেক বইমেলাতেই তাঁর এই মলাটের সম্ভার নিয়ে হাজির হন গোপেশ্বর বাবু৷ পেশার খাতিরে বছরের অন্য সময় তাঁর ঠিকানা হয় শহর ও শহরতলির প্রসিদ্ধ স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। বিভিন্ন সময় ডাক আসে নানা বইপ্রেমীর বাড়ি থেকেও৷ তাঁকে ফোন করে বাড়িতে ডেকে বই বাঁধিয়ে নেন অনেকেই৷ আর বই মলাটের পারিশ্রমিক দিয়ে দিন গুজরান হয়ে যায় গোপেশ্বর বাবুর।
[শতাব্দী এক্সপ্রেসের বিরিয়ানিতে আরশোলা, বমি করে অসুস্থ যাত্রী]
এই পেশার সঙ্গে যুক্ত হয়ে গর্বিত গোপেশ্বর চক্রবর্তী। গর্বিত তাঁর পরিবারও। তাঁর কথায়, বই জীবনের অমূল্য সম্পদ। একে সযত্নে রাখা তাই সকলের কর্তব্য৷ মেলায় হাজার ভিড়ে মধ্যেও মানুষ তাঁকে খুঁজে নেন। আর এটাই পরম প্রাপ্তি গোপেশ্বর বাবুর৷ বর্তমানে তাঁর সঙ্গী একমাত্র ভাই। কিন্তু তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের কেউই আর এই পেশার প্রতি আগ্রহ দেখাননি। তাঁরা সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। ফলে গোপেশ্বর বাবুর পর এই পেশায় তাঁর পরিবারের আর কাউকে দেখা যাবে না। এরপর কী হবে? ভবিষ্যতের কথা ভেবে শঙ্কিত মানুষটি। তবে যতদিন নিজে বাঁচবেন, বইকে সুন্দর করে রাখার পেশাতেই থাকবেন বলে অদম্য জেদ ধরে রেখেছেন৷ কারণ, এতেই তিনি খুশি। এটাই তাঁর বেঁচে থাকার মূল রসদ। তবে গ্রন্থ প্রযত্নে গোপেশ্বর চক্রবর্তীর নিষ্ঠা যতই খাঁটি হোক, বই তৈরি এবং প্রকাশনার ইতিহাসে তাঁর নাম থাকবে না। কারণ, গোপেশ্বর বাবুরা কাজ করে চলেন নিঃশব্দে। কোনও স্বীকৃতির প্রত্যাশা না করেই।
The post ৪০ বছর ধরে মলাট দিতে বইমেলায় হাজির এই ব্যক্তি appeared first on Sangbad Pratidin.