রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়, চেন্নাই: গৌতম গম্ভীরের ঘুম-টুম আর আসছে না। উঠছেন। বসছেন। পায়চারি করছেন। গানটান শুনছেন (সম্প্রতি ‘ও মাহি’ হিন্দি গানখানা মনে ধরেছে বড়, শুনছেন একটানা)। কিন্তু নিদ্রা মহাশয়ের সঙ্গে সখ্যতা হচ্ছে না মোটে। গম্ভীরের কাছের লোকজন বলছিলেন যে, এমনিতেই আইপিএলের সময় তাঁর বিড়ম্বনা যায় প্রবল। টিম জিতুক, হারুক, কিছুতেই আর ঘুম আসে না। মস্তিষ্কে ক্রিকেটীয় স্ট্র্যাটেজি সারাক্ষণ গিজগিজ করে। হারলে কোথায় ভুলভ্রান্তি হল গভীর রাতে খুঁজতে বসেন। জিতলে আবার আক্রমণ করে ‘অ্যাড্রিনালিন রাশ’। এই তো, কলকাতাতেই একখানা ম্যাচের সময়। নাইটরা জিতেছিল। কিন্তু গম্ভীর ঘুমোতে পারেননি। শুনলাম, অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ তাঁকে নাকি জাগিয়ে রেখেছিল ভোর পাঁচটা পর্যন্ত!
নিশ্চিন্তে লিখতে পারি, গৌতম গম্ভীরের ঘুম শনিবার রাতেও আসেনি। চিপকে বৃষ্টি নামার আগে দেখছিলাম, লাল মাটির পিচের পাশে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কিউরেটরের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলছেন। আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, গম্ভীরের ঘোর বিনিদ্র নিশিযাপনের যথেষ্ট কারণও আছে বটে। একটা নয়। দু’খানা। প্রথমত, মাদ্রাজের চিপকে যদি আজ তৃতীয় আইপিএল ট্রফি জেতে কেকেআর, দশ বছরের অভিশাপ কাটবে। দ্বিতীয়ত, রোববার চিপকে ট্রফি জিতলে এক স্বর্ণ-ইতিহাসের মিনারে হাত রাখবেন ক্রিকেট পৃথিবীর ‘ডাবল জি’। জিতলে তিনিই প্রথম ক্রিকেটার হবেন, যাঁর অধিনায়ক ও কোচ হিসেবে আইপিএল (IPL 2024) ট্রফি থাকবে! যা আইপিএলের সতেরো বছরের ইতিহাসে ভূ-ভারতে কেউ করে দেখাতে পারেননি।
ঝঞ্ঝাট হল, গম্ভীরকে (Goutam Gambhir) যাঁরা জানেন-চেনেন, যাঁরা তাঁর সর্বময় সঙ্গী, দ্বিতীয় বিষয়টা শোনামাত্র ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন। নির্দ্বিধায় উত্তর দিচ্ছেন, গৌতম ব্যক্তিগত স্মারক-শিরোপার ধার ইহজীবনে কখনও ধারেননি। এবং সপ্তদশ আইপিএল ফাইনালের পূর্বে তা রাতারাতি বদলে যাবে, আশা করাও অন্যায়। বলা হল, মেন্টর (যা আদতে একপ্রকার কোচই বটে) হিসেবে দু’টো আলাদা আইপিএল টিমকে গত তিন বছরে উপূর্যপুরি প্লে অফ (লখনউ সুপার জায়ান্টস) আর ফাইনালে তুলতে দেখে (কেকেআর) প্রচারমাধ্যম যে তাঁকে ‘গুরু গম্ভীর’ ভূষণে ভূষিত করছে, তা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র উল্লাস-উল্লম্ফন নেই। তাঁর যতটুকু যা তৃপ্তি, জনপ্রিয় জনমতকে পরাভূত করায়।
যেমন, সুনীল নারিন অধুনা অচল আধুলি, অতীতের ছায়ামাত্র। যেমন, আন্দ্রে রাসেল আর আগের মতো নেই। যেমন, মিচেল স্টার্ককে পৌনে পঁচিশ কোটি টাকা দিয়ে কেনা আদতে অর্থের অপচয়। সপ্তদশ আইপিএলের নানান সময় যে সমস্ত আলোচনা নিরন্তর চলেছে। গম্ভীর ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য হল, দ্বিতীয় বিষয় নয়। বরং প্রথমটা তাঁর কাছে অনেক বেশি কাঙ্খিত। দিল্লির ছেলে হলেও আদতে দিল্লিওয়ালা নন যে তিনি। রাজধানীর ঠাঁটবাটের চেয়ে কলকাতার গায়ে সেঁটে থাকা পুরাতনী সৌরভ, গম্ভীরের কাছে অনেক বেশি কাম্য। আদুরে কলকাতার রাস্তাঘাট। হাওড়া ব্রিজ। গঙ্গায় নৌকোবিহার। চায়না টাউন। সিনেমা হল। কেকেআরে (Kolkata Knight Riders) খেলতেন যখন, চলে যেতেন এ সমস্ত জায়গায়। আর সে সব পুরনো ভালোবাসা আজও নষ্ট হয়ে যায়নি। তাই প্রিয় কলকাতার জন্য কিছু করতে পারলে, প্রিয় কলকাতাকে ট্রফি জেতাতে পারলে, তাঁর নিজেকে সুখী লাগে। তাঁর আনন্দ-বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়।
[আরও পড়ুন: তীর্থযাত্রীদের বাসে ধাক্কা পাথরবোঝাই ট্রাকের! মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় উত্তরপ্রদেশে মৃত অন্তত ১১]
তা হলে? তা হলে কি নিজস্ব কোনও তাড়নাই নেই নাইট মেন্টরের? একান্ত নিজের কোনও ইচ্ছে-অনিচ্ছে, মোহ-মায়া, চাওয়া-পাওয়াই কি কাজ করে না তাঁর মধ্যে? নেই কোনও এমন দুর্নিবার আকর্ষণ, যা তাঁর মতো নিঃস্বার্থ ক্রিকেট সাধককেও পারে ঈষৎ টলিয়ে দিতে? আছে, আছে। অবশ্যই আছে। ইংরেজিতে, ‘আনফিনিশড বিজনেস’। বাংলায়, অসমাপ্ত কাজ। গম্ভীর ঘনিষ্ঠরা বলেন যে, ভারতের দু’বারের বিশ্বজয়ী নিজেও জানেন, তিনি ঈশ্বরদত্ত প্রতিভার অধীশ্বর নন। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন না, কোচিং জীবনেও নন। গম্ভীরের ক্রিকেট দু’ভাগে বিভক্ত ছিল– ‘সিক্সটি পার্সেন্ট গ্রিট, ফর্টি পার্সেন্ট ট্যালেন্ট’। অর্থাৎ, ষাট শতাংশ জেদ। চল্লিশ শতাংশ প্রতিভা। প্রতিভাবানরা যা একবারে করতে পারতেন, তা গম্ভীরকে পাঁচ বারের প্রচেষ্টায় আয়ত্ত করতে হত। কোচিংয়ে এসে যে দর্শন টিমে চালান করেছেন তিনি। তবে হ্যাঁ, তাঁর একটা বড় ক্ষমতা আছে। তা হল, নিজের বিশ্বাস, নিজের জেদ টিমের মধ্যে সফল ভাবে সঞ্চারিত করতে পারা। কেউ কেউ বলছিলেন, কেকেআরেও তাই হয়েছে। যাঁদের দিয়ে আর চলবে না বলা হয়েছিল, গম্ভীর তাঁদের দিয়েই টিমকে ফাইনালে নিয়ে গিয়েছেন! দেখতে গেলে, টিমে বিশাল রদবদল তো হয়নি গতবারের চেয়ে। সেই নারিন। সেই ভেঙ্কটেশ আইয়ার। সেই হর্ষিত রানা। সেই বরুণ চক্রবর্তী। নতুন সংযোজন বলতে স্টার্ক এবং জেসন রয়ের বদলি হয়ে আসা ফিল সল্ট।
বলা হল, আসলে জয় ছাড়া কিছু জানেন না গম্ভীর। টিমকেও জেতা ছাড়া কিছু ভাবতে বলেন না। গম্ভীরের নেতৃত্বে খেলা, কেকেআরের ২০১৪ আইপিএল জয়ী দলের সদস্য পীযূষ চাওলা যেমন ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে বলছিলেন, “এখন খুব বলতে শুনি প্রসেস। গৌতি ভাইয়ের (গম্ভীরকে যে নামে ডাকা হয়) একটাই প্রসেস ছিল। তুমি মাঠে নামছো, মানে জিততে নামছো!” গম্ভীরের সহচরকুল বলেন যে, তাঁর দর্শনে কোনও স্বার্থ থাকে না। বড় নামকে রেয়াত করেন না। নামজাদা ‘বটবৃক্ষ’দের ভিড়েও তাই নিশ্চিন্তে শ্বাস নিতে পারে ‘চারাগাছ’-রা। শুধু ও শুধুমাত্র টিমের জন্য খেলতে শেখে। তাতে সামগ্রিক জেদ সৃষ্টি হয়। সফল টিম তৈরির তো তাই রসায়ন–‘সিক্সটি পার্সেন্ট গ্রিট, ফর্টি পার্সেন্ট ট্যালেন্ট’!
শুনলাম, উপরে লেখা প্রতিটা বিষয় গম্ভীর এবার আমদানি করেছেন কেকেআরে। তা ছাড়া জীবনে প্রচুর অধরা অভিলাষও রয়েছে তাঁর। সবচেয়ে বড়, যোগ্য হয়েও দেশের অধিনায়কত্ব না পাওয়া। তাই এক জীবনে যা যা প্রাপ্তিযোগ সম্ভব, সব কিছুকে দুর্বার ধাওয়া করেন গম্ভীর। প্লেয়ার হিসেবে আইপিএল ট্রফি। ক্যাপ্টেন হিসেবে আইপিএল ট্রফি। এবার তার চাঁদমারি, কোচ হিসেবে আইপিএল ট্রফি। পরবর্তীতে সম্ভব হলে, ভারতের কোচ হয়ে বিশ্বজয়। শেষেরটা হবে কি না, সময় উত্তর দেবে। কিন্তু তাঁর আর এক অপূর্ণ সাধ যদি আজ পূর্ণতা পায় চিপকে, তা হলে প্রচারমাধ্যম প্রদত্ত নামটা কিন্তু গ্রহণ করতে হবে গৌতম গম্ভীরকে। তা তাঁর পছন্দ হোক বা না হোক। তিনি চান বা না চান। আমল দিন বা না দিন। ‘গুরু গম্ভীর’!