সোমনাথ রায়, জম্মু: নির্বাচনী নির্ঘণ্ট বলছে আর ক’দিন বাদেই শুরু হয়ে যাবে জম্মু-কাশ্মীরের তিন দফা নির্বাচন। তবে তাওয়াই নদীর মতোই নির্বাচনী আবহ একেবারেই শুকনো গোটা জম্মুতে। পাঁচ বছর আগে লোকসভা নির্বাচনের সময় জম্মু এসেও চোখে পড়েছিল একই ধরনের ছবি। গোটা শহরে সেই অর্থে প্রচারের তেমন ছাপ নজরে আসেনি। অন্তত বঙ্গ রাজনৈতিক রণভূমি আঁচ গায়ে বড় হয়ে ওঠা ইন্দ্রিয়ের কাছে যা ফিকেস্য ফিকে। হাতেগোনা কিছু হোর্ডিং, ব্যানার। যার সিংহভাগই ছিল নির্বাচন কমিশনের সচেতনতা বৃদ্ধি সংক্রান্ত। বেশ কিছুটা পিছিয়ে দ্বিতীয় বারে ছিল ‘আওর একবার, মোদি সরকার’-এর ব্যানার। এবারও ঠিক তার অ্যাকশন রিপ্লে। দিল্লি থেকে আসা কংগ্রেসের এক অবজার্ভার তো আবার শহিদি চকের প্রদেশ দপ্তরে বসে প্রদেশ নেতৃত্বের থেকে জানতে চাইলেন, “এয়ারপোর্ট থেকে এখানে আসার পথে দলের কোনও ব্যানার, হোর্ডিং, পোস্টার চোখে পড়ল না কেন?”
অবশ্য জম্মুর এতখানি ম্যাড়ম্যাড়ে থাকার পিছনে কিছু কারণও আছে। ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে নির্বাচন শুরু হলেও জম্মুর নির্বাচন শেষ পর্যায়ে। ১ অক্টোবর। প্রথম দফায় জম্মু এলাকার যে আটটি বিধানসভা কেন্দ্রে নির্বাচন হচ্ছে, তার সব থেকে কাছেরটিও জম্মু শহর থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। ডোডা। যা প্রাক্তন কংগ্রেস নেতা ও বর্তমানে ডেমোক্র্যাটিক প্রোগ্রেসিভ আজাদ পার্টি প্রধান গুলাম নবি আজাদের এলাকা। স্থানীয়দের বক্তব্য, এই কারণেই এখনও ওয়ার্ম আপ হয়নি জম্মুর।
১০ বছর আগে শেষ যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল তৎকালীন রাজ্যে, সেবার বিজেপি-পিডিপি জোট সরকার তৈরিতে বড় ভূমিকা নিয়েছিল জম্মু। গোটা এলাকা পরিণত হয়েছিল পদ্মবনে। ৩৭টির মধ্যে ২৫টি আসনেই জিতেছিল বিজেপি। আসন পুনর্বিন্যাসের পর এবার ৩৭ থেকে বেড়ে জম্মুর ভাগ্যে এসেছে ৪৩টি আসন। কাশ্মীরে একটি আসন বাড়লেও সেটি রাজৌরি ঘেঁষা। উপত্যকার দলগুলির অভিযোগ, নিজেদের সুবিধার জন্যই জম্মু ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় আসন বাড়িয়েছে বিজেপি। তবে জম্মু শহরের এদিক-ওদিক ঘুরে, রাজনৈতিক দলগুলি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে যে ইঙ্গিত মিলল, তাতে জম্মুতে এবার মাখনের উপর ছুরি চালানোর মতো সহজ কাজ নয় পদ্মশিবিরের।
[আরও পড়ুন: ‘ইফতার আর কারও বাড়ির গণেশ পুজো এক নয়’, মোদি-চন্দ্রচূড় বিতর্কে নয়া তির কংগ্রেসের]
শুধু কাশ্মীর উপত্যকাতেই নয়। জম্মুতেও গত পাঁচ বছরে পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। তবে বলতে দ্বিধা নেই, কাশ্মীরের তুলনায় বেশ কিছুটা কম। এই বিষয়েই রাগ জম্মুর। আসলে জম্মু ও কাশ্মীরের অবস্থা যৌথ পরিবারের সেই দুই ভাইয়ের মতো, যারা মা-বাবার ইচ্ছা ও চাপে একই ছাদের নিচে থাকলেও একে অন্যের প্রতি মনে মনে সব সময় বিষোদগার করেই চলে। তাই ৩৭০ পরবর্তী পর্যায়ে কাশ্মীরিয়তের মন পেতে মোদি-শাহরা যেভাবে সময়, অর্থ, বল কাজে লাগিয়েছেন, জম্মুতে তা ব্যুমেরাংয়ের কাজ করছে।
সঙ্গে জুড়েছে বিদ্যুতের বিষয়। সম্প্রতি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিদ্যুৎ পরিষেবার বেসরকারীকরণ করা হয়েছে। তার পর থেকে বিদ্যুৎ বাবদ খরচ এক লাফে অনেক বেড়ে গিয়েছে বলেই জানাচ্ছেন জম্মু বাস স্ট্যান্ডের পাশে চায়ের দোকানি পাপ্পু ডোগরা, রঘুনাথ বাজারের হোটেল কর্মী রাকেশ রাম থেকে শুরু করে ট্যাক্সিচালক রমন কুন্দনরা। বিদ্যুতের দাম বাড়লেও মুক্তি মেলেনি লোডশেডিং থেকে। যা ক্ষোভ বাড়াচ্ছে আরও। তবে সব থেকে বড় যে সমস্যা, তার নাম বেকারত্ব। যার জেরে নাজেহাল নতুন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। বেশিরভাগকেই কাজের সন্ধানে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হয়েছে। এবার আসা যাক রাজনৈতিক কারণে। এবার জম্মুতে যাঁদের টিকিট দিয়েছে বিজেপি, তাঁদের অনেকেই হালফিলে এসেছেন কংগ্রেস ও ন্যাশনাল কনফারেন্স থেকে। পুরনোরা টিকিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন নির্দল হয়ে। আবার স্থানীয়দের অনেকেরই বক্তব্য, এতদিন যে দলগুলিকে গালমন্দ করতেন বিজেপি নেতৃত্ব, কেন সেখান থেকে আসা প্রার্থীদেরই টিকিট দেওয়া হল?
আপাতত যা পরিস্থিতি, তাতে খুব বড় অঘটন না হলে গতবারের আসন সংখ্যা (২৫) বাড়ানো তো দূর, তা ছোঁয়াও মুশকিল বিজেপির পক্ষে। ১০ বছর আগে মোদি ম্যাজিক বড় ফ্যাক্টর হয়েছিল তাওয়াই নদীর পারের এলাকায়। এবার তা অনেক স্তিমিত, সঙ্গে জুড়েছে নানা ক্ষোভ, অভিযোগ। যদিও জম্মুর মুখপাত্র অরুণকুমার গুপ্তার দাবি, “গত পাঁচ বছরে জম্মু-কাশ্মীর জুড়ে যে বিকাশ হয়েছে, তার প্রতিফলন দেখা যাবে ইভিএমে। জম্মু থেকে আমরা ৩০-এর বেশি আসনে জিতব।” কংগ্রেস সূত্রের খবর, তাদের লক্ষ্য বিজেপি যাতে কোনওমতেই জম্মু থেকে ২০টির বেশি আসন না পায়। হাত শিবিরের মুখপাত্র নীরজ গুপ্তা বলছিলেন, “আমার কথা বিশ্বাস করতে হবে না। রাস্তায় ঘুরুন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলুন। বিজেপির উপর রাগ কতখানি, তা বুঝতে পারবেন। মোদিকে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছিল, তাই লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে ভোট দিয়েছে। এবার তা হবে না।” কী হলে কী হবে। কার বা কাদের কথা সত্যি হবে। জবাব মিলবে ৮ অক্টোবর। তবে তার আগে বিজেপির প্রতি জম্মুর রাগ, ক্ষোভ, অভিমান স্পষ্ট।