উঁহু! নেই! নেই মানে নেই-ই! হোয়াটসঅ্যাপে তন্নতন্ন করে খুঁজলেও ইমোজির মধ্যে হিন্দুদের কোনও মন্দির খুঁজে পাওয়া যাবে না। অথচ খ্রিস্টানের গির্জা আছে, তাও আবার ক্যাথলিক-প্রোটেস্টান্ট ভেদাভেদ মেনে। মুসলমানের মসজিদ আছে, আছে কাবার পবিত্র কালো পাথরটি। বাদ যায়নি ইহুদির সিনাগগ, জাপানের শিন্টো ধর্মের উপাসনালয়ও! শুধু হিন্দুদের বেলাতেই এমন অবহেলা কেন? উত্তর খুঁজলেন অনির্বাণ চৌধুরী
তাহলে হিন্দু ধর্মের মর্ম একমাত্র হোয়াটসঅ্যাপই বুঝতে পারল?
মানছি, একটু বেশি কূটকচালি হয়ে যাচ্ছে! কিন্তু হয়েছে কী, সাম্প্রতিক এক শীতের রাতে হোয়াটসঅ্যাপে এক খুনসুটির কথোপকথনে মন্দিরের ইমোজি খুঁজতে গিয়ে মাথায় হাত পড়ে গেল! এ কী রে বাবা! গির্জা আছে, মসজিদ আছে, কাবার কালো পাথর আছে। ওদিকে হামেহাল ইমোজি হয়ে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে ইহুদিদের সিনাগগ, জাপানি শিন্টো ধর্মও! শুধু মন্দিরটাই বাদ? হিন্দুধর্ম তাহলে বিপন্ন না কি? যাকে বলে কোণঠাসা?
ধন্দ আছে। বিশ্বের ধর্ম নিয়ে নাড়াঘাঁটার দিকে যদি একটু চোখ মেলে চাওয়া যায়, একটা অদ্ভুত জিনিস কিন্তু চোখে পড়বে। সেটা হিন্দু ধর্মেরই জনপ্রিয়তা। এই প্রসঙ্গে ইসকন বা ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি ফর কৃষ্ণ কনশাসনেসের নাম তোলাটা বোধহয় অন্যায় হবে না। সেই কবে থেকে ইউরোপ-আমেরিকা হরে কৃষ্ণ নামে মজেছে ভাবুন দেখি! হরে কৃষ্ণ বলতে বলতে ওদেশের ঠান্ডার মধ্যেও খোল-করতাল নিয়ে খালি পায়ে মন্দিরের হিমশীতল পাথরের মেঝের উপরে নেচে চলেছেন বিদেশিরা! কেউ কেউ আবার সব ছেড়েছুড়ে চলে আসছেন ভারতে। সেটা কি হিন্দু ধর্মের জনপ্রিয়তা নয়?
তার পর আছে তন্ত্রও। বেনারসে একটু অন্য ভাবে ঘোরাঘুরি করলেই বিদেশিদের মধ্যে সেটার জনপ্রিয়তা টের পাওয়া যাবে। তার জন্য, সত্যি বলতে কী, বেনারসে না গেলেও চলবে। স্রেফ ওয়েবসাইটে ভরসা থাকলেই হবে। ইন্টারনেটই দেখিয়ে দেবে কত বিদেশি মানুষ এসে সাধু হয়ে গিয়ে তন্ত্রচর্চা করে চলেছেন। এই তন্ত্র নিয়ে একদা প্রবল উন্মাদনা দেখা গিয়েছিল হিপি আন্দোলনের সময়। গাঁজার ধোঁওয়ায় নিজেকে আড়াল করে, মদের দরিয়ায় ডুব দিয়ে, পরস্পরের শরীর ছুঁয়ে সেই সময় লোক থেকে দেবলোকের অধিকার পেতে চাইতেন বিদেশিরা। ঘুরে বেড়াতেন নদীর ঘাটে, শ্মশানে। সেও কি হিন্দু ধর্মেরই জনপ্রিয়তা নয়? যদি মনে হয় সে অতীতের কথা, তাহলে বর্তমানের দিকেও তাকানো যেতে পারে। মনে করা যেতে পারে আমেরিকার লেখিকা এলিজাবেথ গিলবার্টের কথা। তাঁর ইট, প্রে, লাভ বইতে নায়িকা লিজ জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে একসময় এসে পৌঁছেছিল ভারতে। এসে উঠেছিল উত্তরপ্রদেশের এক মঠে। তাই নিয়েই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায় প্রে বা প্রার্থনা। তাহলে হোয়াটসঅ্যাপ এত উদাসীন কেন?
এই জায়গা থেকেই শুরু হবে কূটকচালির আসল পথচলা! অনেকে বলতেই পারেন ইসকন হিন্দুধর্মের একটি শাখা মাত্র। তাকে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম বলাই যুক্তিযুক্ত। অন্য দিকে তন্ত্রও তাই! সে তিব্বত থেকে ভারতে এল না ভারত থেকে তিব্বতে গেল- তা নিয়ে এখনও মাথা কুটে মরছেন গবেষকরা। চলছে পাতার পর পাতা লেখালেখি। তাহলে হিন্দুধর্ম বলি কাকে?
হিন্দুধর্ম আদৌ কোনও ধর্ম কি না- সেই প্রশ্নটাই সবার আগে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে উত্তর খোঁজার পথে। আসলে হিন্দু শব্দটা তো এসেছে সংস্কৃত সিন্ধু শব্দ থেকে। সিন্ধু সেই সময়ের অবিভক্ত ভারতের উত্তরে পশ্চিম দিকের একটি নদী। যার স্তুতি পাওয়া যাচ্ছে ঋগ্বেদে। ভারত নদীমাতৃক সভ্যতা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই এসেছে সিন্ধু নদীর প্রশংসা। তাছাড়া যদি আর্যদের ধরেই হিন্দু ধর্মের উৎস খুঁজতে হয়, তাহলে তো সিন্ধু শব্দে এসে ঠেকতেই হবে। ইউরোপের মধ্যে দিয়ে আর্যরা ইরান হয়ে এসে পৌঁছল সিন্ধু নদীর তটে। ডেরা ফেলল সেখানেই। এবং বেদ, যাকে মনে করা হয় হিন্দুধর্মের প্রধান ভিত্তি, শুরু করল তার চর্চা। অনেকেই তাই বলে থাকেন, প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতা থেকে ঐতিহাসিক বৈদিক সভ্যতার প্রাথমিক পর্বটাতেই হিন্দু ধর্মের সূচনা হল!
মানে, হিন্দু বলতে ধরে নিতে হবে ওই সিন্ধু নদীর তটে যারা বসবাস করল এবং পরে ভারতের আদিম অধিবাসীদের পরাজিত করে রাজত্ব বিস্তার করল, তাদেরকেই। পরবর্তীকালের আরবি সাহিত্যেও অল-হিন্দ শব্দটির মাধ্যমে সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে বোঝানো হয়েছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ভারতের নামের সমার্থক শব্দ হিসেবে হিন্দুস্তান বা হিন্দুস্থান শব্দটির উৎপত্তি হল। এই শব্দের আক্ষরিক অর্থ “হিন্দুদের দেশ”।
ফলে প্রথমদিকে হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করা হত ধর্মনির্বিশেষে। ভারতীয় উপমহাদেশের সকল অধিবাসীরাই তাই হিন্দু। তাহলে ভারতের অন্য ধর্ম থেকে হিন্দুদের আলাদা করা হল কোন সময়টা? সেটাও চৈতন্যদেবের প্রভাব। চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত ইত্যাদি কয়েকটি ষোড়শ-অষ্টাদশ শতাব্দীর বাংলা গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মগ্রন্থে যবন বা ম্লেচ্ছদের থেকে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের পৃথক করার জন্য শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহার করা হতে থাকল। আবার, অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপীয় বণিক ও ঔপনিবেশিক শাসকেরা ভারতীয় ধর্মবিশ্বাসগুলির অনুগামীদের একত্রে হিন্দু নামে অভিহিত করল। তেমনই ইংরেজি ভাষাতে ভারতের স্থানীয় ধর্মীয়, দার্শনিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলি বোঝাতে হিন্দুইজম বা হিন্দুধর্ম কথাটি চালু হল ঊনবিংশ শতাব্দীতে। অর্থাৎ ভারতে যখন অনেকগুলো ধর্ম ধীরে ধীরে মাথাচাড়া দিল, তখনই কেবল হিন্দু বলে একটা আলাদা শ্রেণিবিভাগ তৈরি হল। তার আগে এরকম কোনও ভাগাভাগির প্রয়োজন পড়েনি!
সবচেয়ে বড় কথা, আজ যাকে আমরা হিন্দুধর্ম বলে চিনছি, যার প্রধান ভিত্তিই এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মন্দির এবং মূর্তিপূজা, তাও তো হিন্দুধর্মের শুরুতে ছিল না। বৈদিক সভ্যতা ভীষণভাবেই উপাসনা করত প্রাকৃতিক শক্তির। এই বৈদিক সভ্যতায় অর্থাৎ ওই আমলে কোন মূর্তি পূজা করা হত না। সেই সময় হিন্দুদের প্রধান দেবতা ছিলেন ইন্দ্র, বরুন, অগ্নি এবং সোম। বজ্রের শক্তি ধরা দিয়েছিল ইন্দ্রের মধ্যে। তেমনই বরুণে জল, অগ্নিতে আগুন, সোমে চাঁদ। তাঁরা যজ্ঞের মাধ্যমে পূজিত হতেন। তখনকার ঈশ্বর আরাধনা হত যজ্ঞ এবং বেদ পাঠের মাধ্যমে। সকল কাজের আগে যজ্ঞ করা ছিল বাঞ্ছনীয়। সে আমলে কোন মূর্তি বা মন্দির ছিল না।
সব মিলিয়ে কী দাঁড়াল? না, হিন্দু ধর্মের শিকড়ে মন্দির ছিলই না! বা এও বলা যায়- মন্দির হিন্দু ধর্মকে চেনার মাধ্যম নয়। সেই জন্যই কি হোয়াটসঅ্যাপ হিন্দু ধর্ম বোঝাতে মন্দিরের ইমোজি রাখেনি?
হতেই পারে! আসলে যে কটা ধর্মীয় স্থাপত্যের ইমোজি দেখা যাচ্ছে হোয়াটসঅ্যাপে, তাদের সবকটারই নির্দিষ্ট একজন প্রতিষ্ঠাতা দেখা যায়। খ্রিস্টানদের যিশু, মুসলমানের মহম্মদ, ইহুদিদের মোজেস, শিন্টোর কামি বা বুদ্ধ। হিন্দু ধর্মের সেরকম কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। ফলে কোনও নির্দিষ্ট চিহ্নও খুঁজে পাওয়া মুশকিলের! স্বস্তিক চিহ্ন দিয়ে তা হবে না, ওমকারও তো সব হিন্দুরা মান্য করেন না!
তাই প্রশ্ন জাগে- হিন্দুধর্মের আসল চেহারাটা কি এত বিস্মৃতির মধ্যেও খেয়াল করল হোয়াটসঅ্যাপই?
The post হোয়াটসঅ্যাপে মিসিং হিন্দু ধর্মের ইমোজি! appeared first on Sangbad Pratidin.