কথায় কথায় কিছু একটা হলেই ওষুধের দোকানে গিয়ে নিজের মতো ওষুধ কিনে কিংবা পুরনো প্রেসক্রিপশন দেখে আগের ওষুধ খেয়ে সমাধান খোঁজার মানুষের সংখ্যাটা নেহাতই কম নয়। খুব সহজে শরীর ভালো রাখতে গিয়ে হিতে-বিপরীত হওয়ার শঙ্কা সর্বাধিক। এই কারণেই আমাদের দেশে তথা এ রাজ্যে সঠিক চিকিৎসার অভাবে অসুস্থতার হার এত বেশি। কোন কোন ক্ষেত্রে সেল্ফ মেডিকেশন মারাত্মক তা নিয়েই আলোচনা করলেন এস সি বাগচী আরোগ্য সদন প্রাইভেট লিমিটেডের ফ্যামিলি মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. সুমনা বাগচী।
কাকলি চক্রবর্তী, বয়স ৫৬। হঠাৎ করেই একদিন চেম্বারে এলেন পায়ের ব্যথা নিয়ে। এতটাই ব্যথা যে পা নাড়াতে পারচ্ছে না। কথায় কথায় জানা গেল, ওঁর এই সমস্যা একদিনের নয়, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এমন ব্যথা। তাহলে এতদিন পর কেন চিকিৎসা করাতে এলেন? তিনি জানালেন, তাঁর এক বন্ধুর এমন দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটুতে সমস্যা রয়েছে। তিনি একটি ওষুধ খেয়ে খুবই উপকার পেয়েছিলেন, তাই তার কথা মতোই কাকলি দেবীও প্রায় বছরখানের ওই ওষুধটিই খেয়ে গিয়েছেন। এতদিন ঠিক থাকলেও আর কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
বুকে ব্যথা থেকে বুকজ্বালা, পেটে ব্যথা থেকে মাথা ঘোরা, জ্বর, সর্দি-কাশি কিংবা কোমরে-হাঁটুতে খিঁচ সবেতেই আমাদের বেশিরভাগেরই অভ্যাস রয়েছে বাজার থেকে নিজের মতো করে ওষুধ কিনে সুরাহা খোঁজা। কিংবা কারও কথামতো ওষুধ খেয়ে ভালো থাকা। এটা বাঙালিদের চিরাচরিত অভ্যাস। এতে নাকি হ্যাপা কম, কিন্তু সহজে উপশম। আপাতভাবে এই অভ্যাসে ঝামেলা কম মনে হলেও ডাক্তারি পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন কিন্তু মারাত্মক একটি কুঅভ্যাস।
এ ব্যাপারে কোনো কার্যকরী আইন বা নিয়ম-নীতি নেই যা এই প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, স্থানীয় ফার্মাসি বা ওষুধের দোকানই একমাত্র প্রথম পরামর্শের জায়গা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, বেশিরভাগ ফার্মাসিতেই যোগ্য ফার্মাসিস্ট না থাকায় চিকিৎসা নিয়ে সঠিক পরামর্শ পাওয়া যায় না। এর পাশাপাশি, চিকিৎসকের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ প্রেসক্রিপশন অনুসরণ করতে আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেকেই প্রেসক্রিপশনের পুরো ডোজ না নিয়ে, শুধু কিছু ওষুধ কেনেন অথবা পুরনো প্রেসক্রিপশনে দেওয়া ওষুধ আবার ব্যবহার শুরু করেন। এই প্রবণতাই বিপদ ডেকে আনে।
এছাড়া লোকমুখে প্রচলিত ওষুধ খেয়ে ভালো থাকার চেষ্টা তো আছেই। তবে এটি পরিস্থিতি আরও জটিল করে তোলে এবং সঠিক চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব ঘটায়। প্রাথমিক লক্ষণগুলি উপেক্ষিত হয়ে যায়। অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ার পর চিকিৎসকের কাছে গেলে তখন হয়তো রোগ বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। যেমনটা হয়েছিল কাকলি দেবীর। বর্তমানে এমন পরিস্থিত যে ওঁর ডায়ালিসিস শুরু করতে হবে, ব্যথার ওষুধ টানা খেয়ে কিডনির অবস্থা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক।
কোন কোন ক্ষেত্রে নিজে থেকে ওষুখ খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে
মাথাব্যথা: সাধারণ মাথাব্যথার জন্য পেনকিলার নিলে চোখের কোনো গুরুতর সমস্যা বা স্নায়ুজনিত অসুখ উপেক্ষিত হয়ে যেতে পারে। উলটে অযাচিতভাবে এই মাথাব্যথার ওষুধ খেয়ে আসল ব্যথা তো কমেই না, সঙ্গে গ্যাসের সমস্যা শুরু হতে পারে।
জ্বর: জ্বরের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে, যেমন ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, টিবি বা লিউকেমিয়া। শুধুমাত্র প্যারাসিটামল খেয়ে তাপমাত্রা কমিয়ে ফেলা চিকিৎসার মূল কারণকে উপেক্ষা করতে পারে এবং মারাত্মক পরিণতি ঘটাতে পারে।
ব্যথা: ব্যথানাশক ওষুধগুলি গ্যাসট্রাইটিসের পাশাপাশি কিডনির জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ ডেকে আনতে পারে। অনেক সময়ই কিডনির এমন সমস্যাগুলি সাইলেন্ট থাকে। ফলস্বরূপ রোগীর জীবন বিপন্ন হতে পারে।
ক্লান্তি বা দুর্বলতা: অনেকে সুস্বাস্থ্যের জন্য বিভিন্ন স্বাস্থ্য সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করেন, তবে যদি গ্লুকোজ বা অন্য কোনও সাপ্লিমেন্ট একজনের শরীরে অনুপযুক্ত হয়, তবে সেটা মারাত্মক হতে পারে। এমনকী, অ্যানিমিয়ার মতো সাধারণ সমস্যা গুরুত্ব সহকারে চিকিৎসা না নেওয়ার ফলে গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।
মূত্রথলির সমস্যা: অনেকেই ইউরিনারি ইনফেকশন বা যোনি সমস্যার চিকিৎসা নিয়ে সচেতন নন। ভুল চিকিৎসা এবং অসম্পূর্ণ চিকিৎসার ফলে এই ধরনের সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়ে যায়। এর থেকে প্রাণসংশয়ও দেখা দিতে পারে।
পেটের অসুখ বা বদহজম: মুঠো মুঠো অ্যান্টাসিড বা হজমের ওষুধ খাওয়ার প্রবণতা অনেকেরই আছে। কথায় কথায় অল্প কিছু খেলেই হজমের ওষুধ নেশার মতো সেবন করেন অনেকেই। এ এক মারাত্মক খারাপ অভ্যাস। সবার জানা দরকার পেটের সমস্যা মানেই তা কিন্তু হজমের সমস্যা নয়। এর পিছনে আরো গভীর রোগের কারণ থাকতে পারে।
আসলে মানবদেহ একটি অত্যন্ত জটিল যন্ত্র, যা সঠিক যত্ন এবং পুষ্টির মাধ্যমে সুন্দরভাবে চালনা করা সম্ভব। দ্রুত সুস্থ হতে গিয়ে নিজের মতে চিকিৎসা না করে সঠিক পথ অনুসরণ করা সবসময় জরুরি, আর চিকিৎসকের পরামর্শ বেদবাক্যের মতো মেনে চলা দরকার। তবেই ভালো থাকবেন। স্বাস্থ্য গুরুত্বপূর্ণ, এবং সঠিক চিকিৎসা সঠিক সময়ে করলে তবেই জীবন রক্ষা করা সম্ভব।
ফোন - ৯৮৩০৪৯৩০১৬ / ৯৮৩০৮৫০৩০৯