কুণাল ঘোষ: সরকার আর পার্টি মিলেমিশে গেলে পরিণাম কী হয়? পার্টিতে শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের স্বাধীনতা কোন সীমা অতিক্রম করলে তাকে বিচ্যুতি বলা যায়? গরিবের জমির পাহারাদার থেকে পার্টিনেতারা জমির দালাল হয়ে গেলে পচন কোন গভীরে পৌঁছয়? এবং, এক নারী স্বেচ্ছায় সচ্ছল গতে বাঁধা জীবনের গণ্ডি থেকে নিজেকে বার করে জঙ্গলমহলের ঠিকানার উপেক্ষিত, অত্যাচারিতদের সঞ্জীবনী মন্ত্র শুনিয়ে কীভাবে হয়ে উঠতে পারেন গবেষণার বিষয়বস্তু? প্রশ্নগুলির উত্তর একসঙ্গে দিয়েছেন অভিনেত্রী গার্গী রায়চৌধুরী এবং পরিচালক অরিন্দম শীল। তাঁদের ‘মহানন্দা’ (Mahananda) ছবিতে।
বৃহস্পতিবার কোয়েস্ট আইনক্সে ‘মহানন্দা’র বিশেষ প্রদর্শন দেখলাম। এই প্রতিবেদন সিনেমা রিভিউ নয়। এই প্রতিবেদন একটি সিনেমার খবর, যে ধরনের বাংলা ছবি সময়ের দলিল হয়ে থাকে এবং যেগুলি তৈরি হওয়া এবং দেখা এখনকার বঙ্গসংস্কৃতির পক্ষে বিশেষ জরুরি।
গার্গীর (Gargee RoyChowdhury) ‘মহানন্দা’ কি মহাশ্বেতা দেবী? ছবিতে কি মেধা পাটকর থেকে সিঙ্গুরের তাপসী মালিকদের চরিত্ররা আমাদের সামনে আসছে? আসছে অবশ্যই এবং বহুমুখী ভাঙাগড়ার এক অনিঃশেষ চালচিত্রের ছায়াপথ রচনা করছে।
[আরও পড়ুন: ‘প্রথমে দ্বিধা ছিল’, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অভিযান’ তৈরি নিয়ে কেন একথা বললেন পরমব্রত?]
ছবিতে দুই তরুণ-তরুণী পৌঁছে যায় জঙ্গলমহলে ‘মা’ মহানন্দার কাছে। দু’জনেই বামপন্থী। সময়টা লাল-জমানা। তরুণীর উদ্দেশ্য নিয়মের বাইরে যাওয়া এই লেখিকা, সমাজকর্মী এবং জঙ্গলমহলের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য নিবেদিতপ্রাণ মহানন্দাকে নিয়ে গবেষণা। এবং, সেও পরে আবিষ্কার করে সঙ্গী কমরেডের আসল উদ্দেশ্য জমিদখলের প্রেক্ষিত প্রস্তুত করা। এই আঁকাবাঁকা পথ ধরেই একটি চরিত্র এবং সময়কে আবিষ্কারপর্ব চলেছে। জঙ্গলবাসীর অধিকার ও উন্নয়ন, প্রতিবাদের সঙ্গে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুর যেন মিলেমিশে বার্তা দিয়ে পরিণতি দেখিয়েছে, যাকে যুগ-যুগান্তরের সতর্কবার্তাও বলা যেতে পারে।
গার্গী অসাধারণ। বৃদ্ধার মেক আপ শুধু নয়, কাঠামোতে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। যৌবন ও বার্ধক্যে সমান সাবলীল গার্গী। মিছিলের বেড়া ভাঙায় দৃপ্ত, জঙ্গলবাসী তরুণ-তরুণীদের অভিভাবকের ভূমিকায় যথাযথ এবং ‘সাথীহারার গোপন ব্যথা’র আবহে ব্যক্তিগত জীবনের ভাঙচুরের ঘটনায় অতীতমন্থিত ক্লান্তির বাহক।
বাংলা ছবিতে বায়োপিক ঘরানায় এমন মেক আপ, অভিনয় বিরলের মধ্যে বিরলতম। পরিচালক অরিন্দম শীলের (Arindam Sil) কাজও যথেষ্ট কঠিন ছিল, সুনিপুণভাবে শেষ করেছেন। দেবশঙ্কর হালদার (Debshankar Halder) চিরকালই অন্য উচ্চতার। অর্ণ মুখোপাধ্যায়, ইশা সাহাও নজর কাড়ছেন। বিক্রম ঘোষের (Bickram Ghosh) সংগীত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা ব্যতিক্রমী। তাঁর সব সহকর্মীই উজাড় করে দিয়েছেন নিজেদের।
আবার বলছি, এটি সিনেমা রিভিউ নয়। একজন রাজনীতিসচেতন নাগরিক ও সাংবাদিক হিসাবে ‘মহানন্দা’ দেখে এসে পাঠক-পাঠিকাদের বলছি, দেখা দরকার। দেখে আসুন।