জয়ন্ত ঘোষাল: পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট তথা সেনাপ্রধান পারভেজ মুশারফ (Pervez Musharraf) প্রয়াত হলেন। আমরা ভারতীয়রা তাঁকে কারগিল যুদ্ধের রূপকার খলনায়ক হিসাবেই মনে রেখেছি।
যে-মানুষটা এমন কুশলী আক্রমণাত্মক যোদ্ধা ছিলেন, আফগানিস্তান যুদ্ধের সময় এক নবীন ব্রিগেডিয়ার হিসাবে বিন লাদেনের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে সোভিয়েত-বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন, সেই মুশারফ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে ‘অ্যামালোইডোসিস’ নামে এক বিরল অসুখে ভুগে মারা গেলেন। মৃত্যুর আগে দীর্ঘদিন কষ্ট পেলেন। তারপর ২০২৩-এর ৫ ফেব্রুয়ারি রবিবার সকালে দুবাই শহরে নির্বাসিত অবস্থায় ৭৯ বছর বয়সে শেষ শ্বাস ত্যাগ করলেন।
কর্মসূত্রে একাধিকবার পারভেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথা বলার সুযোগ হয়েছে। ইসলামাবাদের প্রেসিডেন্ট হাউসেও আমরা কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক ওঁর সঙ্গে দেখা করেছিলাম। দীর্ঘ কথোপকথন। কথা বলতে খুব ভালবাসতেন। আর, মিডিয়ার মানুষজন হলে তো কথাই নেই! পারভেজ সম্পর্কে সেসব অকথিত কিছু কাহিনির হদিশ দিতেই এই লেখা। কিছু হয়তো আপনাদের জানা, কিছু অজানা। কিন্তু পারভেজের ব্যক্তিত্বের রসায়নটা ছিল চিত্তাকর্ষক, বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৯৯৯ সালে রক্তপাতহীন সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নওয়াজ শরিফকে (Nawaz Sharif) সরিয়ে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন মুশারফ। তারপর সেই পারভেজ-ই ২০০১ সালের জুলাই মাসে দিল্লি আসেন। আগ্রায় শীর্ষ বৈঠকে বসে পড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Vajapayee) সঙ্গে। মনে আছে, পারভেজের ভারত-সফর নিয়ে বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা-বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক বসে। উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানী (LK Advani) এই সফরের বিরোধিতা করেন। তাঁর যুক্তি ছিল, পারভেজ সমগ্র দুনিয়ায় সামরিক অভিযানের উপর বৈধতা চাইছেন। ‘লাহোর বাস’ মৈত্রী কূটনীতির পর যিনি কার্গিল যুদ্ধ (Kargil War) করলেন, তাঁকে আমরা ভারতে আমন্ত্রণ জানাব শান্তি আলোচনার জন্য? পাকিস্তানকে কি কখনও বিশ্বাস করা উচিত? আডবানী এ কথা বললেও, বাজপেয়ী শান্তি আলোচনার পক্ষে ছিলেন। বিদেশমন্ত্রী যশবন্ত সিং, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ব্রজেশ মিশ্র (Brajesh Mishra) বাজপেয়ীকে সমর্থন করলেন। আমেরিকাও তখন দু’পক্ষকে বসতে চাপ দিচ্ছিল।
যাই হোক, পারভেজ তো এলেন। রাষ্ট্রপতি ভবনে উঠলেন। সেখান থেকে যাবেন আগ্রায়। বিকেলে উপ-প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানী গেলেন ‘ডিক্টেটর’-এর সঙ্গে বৈঠক করতে। আমি নর্থ ব্লকে আডবানীর ব্যক্তিগত সচিব দীপক চোপড়ার ঘরে বসে আছি, যাতে উনি ফিরলেই জানতে পারি, কী কথা হল। আডবানী ফিরলেন। মুখ খুব গম্ভীর। শক্ত হয়ে গিয়েছে চোয়াল। আডবানী পিছন পিছন ঘরে ঢুকলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব কমল পাণ্ডে। আমিও ঢুকে গেলাম ভিতরে।
[আরও পড়ুন: ‘ডেটলে মুখ ধুয়ে আসুন’, কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় কংগ্রেসকে খোঁচা নির্মলার]
কমল পাণ্ডে আডবানীকে বললেন, এভাবে ওঁর কথা বলাটা ঠিক হয়নি। সবাই জানে, পাকিস্তান দাউদকে আশ্রয় দিচ্ছে। তবু উনি অসত্য বললেন? আডবানী বললেন, পাণ্ডেজি, আপ পিএমও-কে সাথ বাত কিজিয়ে। এরপর কমল পাণ্ডে চলে গেলেন ওঁর ঘরে, দ্রুত গতিতে। কমল পাণ্ডে চলে গেলে আডবানীজিকে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? আদবানি উত্তর না দিয়ে হটলাইন, যাকে সে-সময়ে ‘র্যাকস ফোন’ বলা হত, তাতে গোয়েন্দা প্রধান কে. পি. সিং-কে বললেন, ‘কে. পি., আপডেট মি হোয়্যার ইজ দাউদ। জাস্ট নাও। আর্জেন্ট।’ এরপর তিনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, পারভেজের সঙ্গে দেখা করে আমি প্রথমেই বলেছি, ‘উই ওয়ান্ট দাউদ। দাউদকে না-দেওয়া পর্যন্ত কাশ্মীর (Kashmir) নিয়ে শান্তি আলোচনা হতে পারে না।’ পারভেজ তখন বললেন, আডবানীজি, তুমি ‘স্মল টক’ করছ। এই ধরনের কথাবার্তা তোমাকে শোভা দেয় না। আডবানী অপমানিত হন। দু’পক্ষেই অফিসারদের প্রতিনিধি দল ছিল। এরপর মুশারফ বলেন, দাউদ পাকিস্তানে নেই। ও পাকিস্তানে আছে, তার প্রমাণ দাও। এরপর কে. পি. সিংয়ের ফোন, আডবানিজি, পারভেজ খুব চালাক। দিল্লি আসার আগে পাক সেনা দাউদকে ব্যাংককে পাঠিয়ে দিয়েছে, ভুয়া পাসপোর্ট দিয়ে। তাই ও এখন করাচি বা রাওয়ালপিন্ডিতে নেই। হয়তো পরে আবার চলে আসবে।
পারভেজ এমনই! আর ডিক্টেটরদের মনের অনেক স্তর থাকে। ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট হাউসে থাকতেন, কিন্তু রাওয়ালপিন্ডির সেনাপ্রধানের বাড়িটি কখনও ছাড়েননি, যেমন ছাড়েননি সেনা ইউনিফর্ম। পারভেজ জানতেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলেও, আসল ক্ষমতার উৎস সেনাছাউনি। পারভেজ খুব আড্ডা মেরেছিলেন সেদিন আমাদের সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, বলিউডের মাধুরী দীক্ষিত (Madhuri Dixit) ওঁর প্রিয় অভিনেত্রী। প্রায়ই রাতের বেলা বাড়ি ফিরে একটা বলিউড ছবি দেখা ওঁর নেশা। দিল্লি জন্মস্থান, তাই দরিয়াগঞ্জকে কখনওই ভুলতে পারেন না। আর-একটা কথা মনে আছে বলেছিলেন, পাকিস্তানের তিনটে জিনিস নেই, যা ভারতের আছে। কী কী জানেন? একটা লতা মঙ্গেশকর, দ্বিতীয় একজন শচীন তেন্ডুলকর, আর তাজমহল। ইসলাম ধর্মে যদিও কুকুর পোষাকে উৎসাহ দেওয়া হয় না, কিন্তু পারভেজের বাড়িতে বেশ কিছু পোষা কুকুর ছিল। ওঁর খুব প্রিয় ছিল তারা।
[আরও পড়ুন: বিতর্কের মাঝে জমি মিউটেশনের আবেদন অমর্ত্যর, ২০ ফেব্রুয়ারি শুনানির সম্ভাবনা]
পারভেজ আমলেই ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সংসদ আক্রমণ করে পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠন। ১৪ জন মারা যায়। সেই পারভেজ-ই ২০০২ সালে ‘সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে’ বক্তৃতা শেষ করে ডায়াস থেকে সটান হেঁটে এসে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়ান বাজপেয়ীর সামনে। পাশে তখন বসে বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানের প্রধানমন্ত্রীরা। হঠাৎ মঞ্চের সবাইকে চমকে দিয়ে শুধু বাজপেয়ীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে ফিরে গেলেন মুশারফ। মুখে হাসি। আবার শান্তি স্থাপনের বার্তা। ২০০৬ সালে ভারতীয় ক্রিকেট টিমকে পাকিস্তানে বরণ করলেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি (MS Dhoni) ৭২ রান করে ভারতকে জেতান। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে এসে ধোনির সঙ্গে হ্যান্ডশেক। তারপর বললেন, আপনার চুলের এই স্টাইলটা দারুণ। আমার মত হল, চুলটা কাটবেন না। এই স্টাইলেই আপনাকে সবচেয়ে ভাল লাগে।
আডবানীর সঙ্গে দিল্লিতে দাউদ নিয়ে ঝগড়া করেন, আগ্রা বৈঠকেও আডবানীর সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে পারভেজের তুমুল বিতণ্ডা হয়। কিন্তু সেই আডবানীকেই আমন্ত্রণ জানিয়ে পাকিস্তানে নিয়ে যান মুশারফ। শিবশঙ্কর মেনন তখন ইসলামাবাদে ভারতীয় হাই কমিশনার। মেননের সঙ্গে পারভেজের বেশ সখ্য গড়ে ওঠে। দু’জনে একসঙ্গে রোজ সকালে গল্ফ খেলতেন। মনে আছে, আডবানীকে পারভেজ সময় দিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাছাউনিতে, তাঁর সেনাপ্রধানের বাসভবনে। সঙ্গে মেনন ছিলেন। সে-বৈঠকে পারভেজ মেনে নেন যে, পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গি ও সেনা ঘাঁটি আছে। তিনি কথা দেন, এই ঘাঁটিগুলো তিনি ধীরে ধীরে শেষ করবেন। সাংঘাতিক খবর! আদবানি এ-কথা যখন আমাকে বলছিলেন, তখন মেনন ছিলেন। আমি বললাম, ‘বিগ স্টোরি’। মেনন আডবানীকে বললেন, এ খবর এখন না-লেখাই ভাল। কারণ এটা লিখলে পাকিস্তানের ভিতর পারভেজের বিরুদ্ধে মোল্লাতন্ত্র সক্রিয় হয়ে যাবে। উনি বিপদে পড়বেন, তাতে ভারতের স্বার্থও লঙ্ঘিত হবে। আডবানী সে-কথা মেনে বললেন, এসব তবে এখন লিখো না। ভারতীয় গোয়েন্দাদের তৈরি করা জঙ্গি-ঘাঁটির একটি তালিকা আডবানী সেদিন আসলে পারভেজের হাতে তুলে দেন। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কথা রাখেনি। এখনও পর্যন্ত না। বাজপেয়ীর সঙ্গে দু’বার, পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের (Manmohon Singh) সঙ্গেও পারভেজ তিন-তিনবার বৈঠক করেন। না, কাজের কাজ কিছু হয়নি।
ইতিহাসের চাকা ঘুরতেই থাকে। পারভেজকেও ইস্তফা দিয়ে পাকিস্তান ছাড়তে হয়। ২০১৬ সালে অসুস্থ হয়ে দুবাই যান। গত বছর তো তাঁর মৃত্যুর গুজব রটে যায়। স্ত্রী বিবৃতি দিয়ে বলেন, ঘোরতর অসুস্থ, তবে তিনি বেঁচে আছেন। অবশেষে সেই পারভেজ বিদায় নিলেন। ‘খলনায়ক’-এর স্মৃতি থেকে গেল এই রিপোর্টারের ঝোলায়।