(প্রথম পর্বের পর)
অভিরূপ দাস: নিশুত রাতে রানাঘাটের ভাঙা বাড়ির ভিতর থেকে ভেসে আসা ধস্ত নারীকণ্ঠ শুনে পাড়ার লোক ভাবেন, এই কি সেই রাণু মণ্ডল? যাঁর গলার এই দু’টি লাইন তিন বছর আগে কাঁপিয়ে দিয়েছিল কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী! আপনিই কি রাত্রে গানের চর্চা করেন? অতীতের ঝাঁপি খুলে বসলেন রাণু (Ranu Mondal)। “চর্চা আবার কী? ওসব আমার কোনওদিন ছিল না। খাতাবই ছুঁয়ে দেখিনি কখনও, সুযোগই হয়নি। গানও শিখিনি, মাইকে শুনে শুনে যেটুকু।” জানালেন, বাড়িতে মোবাইল, টিভি, রেডিও, কিচ্ছু নেই। সময় কাটাতে একা রাতে মাঝে মাঝে দু’এক কলি গুনগুন করেন। এ প্রসঙ্গেই উঠে এল ছোটবেলার কথা। মা-বাবার একমাত্র মেয়ের জীবন শুরুই হয় অবহেলা ও দারিদ্রকে সঙ্গে করে।
বাল্যস্মৃতি মনে পড়লে এখনও যন্ত্রণায় বেঁকে যায় মুখ। “বাপের এক মেয়ে ছিলাম। বাপ ছিল স্বার্থপর, মাকে ছেড়ে আবার বিয়ে করেছিল। যদ্দিন ছিল, মাকে দিনরাত নির্যাতন করত। ওসব কথা মনে রাখতে চাই না।” নিজের সংসারজীবনও সুখের হয়নি। একমাত্র মেয়ে থেকেও নেই। তীক্ষ্ণ স্বরে ফুঁসে উঠলেন, “মেয়েটা পালিয়েছে। ঈশ্বর যদি চান, ফিরে আসবে। এত লোক তো দূর থেকে দেখা করতে আসে! কই, সে তো মায়ের কোনও খবর নেয় না!” ছোটবেলা কেটেছিল কৃষ্ণনগরে। মুম্বইতে লোকের বাড়ি কাজও করেছেন কিছুদিন। শেষমেশ ভাগ্য অন্বেষণে রানাঘাটে।
[আরও পড়ুন: ‘বলিউড ছোট ইন্ডাস্ট্রি, আমাকে পারিশ্রমিক দিতে পারবে না!’ বিস্ফোরক দক্ষিণী তারকা মহেশ বাবু ]
ক্ষোভ, বিরক্তি, শোক, আক্ষেপ, এবং পেয়েও হারানোর হতাশা। একদা ‘সেলিব্রিটি’ রাণু মণ্ডলের প্রতিটা বাক্যে এখন এসবেরই মিলিত বিস্ফোরণ। ঘেন্নায় একদলা থুতু ফেললেন, “যখন আমার গানের আকাশছোঁয়া কদর হল, তখন কত খাতির! এদিকে যখন ভিক্ষে করতাম, ফিরেও দেখত না! সবাইকে চিনে নিয়েছি। এখন কেউ মিষ্টি করে কথা বললে গা জ্বালা করে। ভাল সময় ছিল যখন, আমার কাছে গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছে। এখন অভাবে পড়েছি, পেটে দুটো ভাত দিতে পারে না।”
এহেন কপর্দকশূন্য চালচুলোহীন রাণু মণ্ডলকে ঘিরে দালালরা মাছির মতো ভনভন করছে বেগোপাড়া চত্বরে। স্টেশন থেকে তাঁর বাড়ির পথে ধরতে গেলেই হাত দেখান অগুনতি। হিমশীতল কণ্ঠে তাঁদের সপাট প্রশ্ন, “কোথায় যাচ্ছেন?” রাণু মণ্ডলের নাম বললেই চোখ কুঁচকে তাকান আগন্তুক। জানিয়ে দেন, “অনুমতি ছাড়া ও বাড়িতে ঢোকা যাবে না।” অনুমতি মানে কড়কড়ে কতগুলো টাকার নোট। একদা পাড়ার ভিখিরি এখন ইউটিউবে ভাইরাল। তাঁকে ঘিরে জমিয়ে ব্যবসা ফেঁদেছেন জনাকয়েক বেকার। বেচারা রাণু জানেন না, তাঁর নসিব না বদলালেও নামযশের সুবিধা নিয়ে ঘোলাজলে মাছ ধরছেন কেউ কেউ।
এদিকে লতাকণ্ঠীর ঘরে উনুন জ্বলে না। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টই যে নেই তাঁর। চান না ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে। খ্যানখ্যানে গলায় বলেন, “টাকা কই যে ব্যাঙ্কে রাখব? আর ব্যাঙ্ক মানে তো চিটিংবাজ।” ভালবেসে কেউ দু-দশ টাকা দিলে ভরে রাখেন তাঁর ছেঁড়া লাল কাপড়ের সুটকেসে। বলেন, “ঘরে আমার যিশুখ্রিস্ট আছে। ঈশ্বর জানেন আমার কতটুকু আয়।”
হরেক সাধ তাঁর। সকালের টিফিনে একটু পরোটা খাবেন। কিংবা গরম দুটো রুটি দিয়ে একটু আলুর তরকারি। ছেলেমানুষি আবদারে চেয়েও ফেলেন সে সব। পড়শিরা বলেন, “খাবার দিতে গেলেও বিপদ। মুরগির মাংস খেয়ে বলেন কুকুরের মাংস! বিষ মেশানো আছে ভেবে ছুড়ে ফেলে দেন যখন তখন।” আসলে জীবনের ঘাত প্রতিঘাত তাঁকে করে দিয়েছে বদমেজাজি, কর্কশ। আত্মীয়-পরিজন, রোজকার ভিডিও বানাতে আসা মানুষগুলোর কাছে ঠকতে ঠকতে বিশ্বাস শব্দটাই তাঁর কাছে দূরতর দ্বীপ।
এরই মধ্যে কে একজন এসে আবদার করে, ফেস পাউডার এনেছি দিদি। একটু মাখবেন? জট পড়া চুলে হাত বোলাতে বোলাতে রাণু বলেন, ওসব দরকার নেই। বাইরে বড্ড গরম। একটা টেবিল ফ্যান নিয়ে আয়। একটু হাওয়া খাই। (শেষ)