ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: বেসরকারি হাসপাতাল মানেই বিশাল চিকিৎসার খরচ। সঙ্গে আনুষঙ্গিক প্যাথলজিক্যাল টেস্টের ধাক্কা। সবমিলিয়ে এক বিশাল সংসার চালানো দায়। এমন সব সমস্যার মুশকিল আসান করতে রাজ্যে চালু হয়েছে স্বাস্থ্যসাথী হেলথ স্কিম (Swasthya Sathi Health Scheme)। যে চিকিৎসার ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত সব খরচের জামিনদার পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
স্কিমের আওতায় কারা
কেমন সেই স্বাস্থ্যসাথী স্কিম? কীভাবে এবং কারা এই সুবিধা পেতে পারেন? এই বিষয়ে জানতে আগ্রহী আমলা থেকে কেরানি, বড় ব্যবসায়ী থেকে নিম্নবিত্ত। মোদ্দা কথা, সবার জন্য নিখরচায় চিকিৎসা পরিষেবা। স্বাস্থ্যসাথীর আসল কথা এখানেই।
চার বছর আগের কথা। ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজ্য মন্ত্রিসভার অধিবেশনে গৃহীত হল স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প। রাজ্যের মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে তৈরি হল স্টেট লেভেল ইমপ্লিমেন্টেশন কমিটি। সেই বছরের ৩০ ডিসেম্বর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প ঘোষণা করলেন। বলা হল, রাজ্যের নাগরিকদের নিখরচায় বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়া। যার সব খরচ বহন করবে রাজ্য সরকার। অর্থাৎ ক্যাশলেস হেলথ স্কিম।
বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরুর একমাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে চিকিৎসার খরচ চলে যাবে সরকারি কোষাগার থেকে। রাজ্যের প্রায় ১,০৬১ বেসরকারি হাসপাতালকে এই স্কিমের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে কর্পোরেট হাসপাতাল ২১টি। আরও অন্তত পাঁচশো হাসপাতাল এবং নার্সিংহোম এই পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত হবে। অর্থাৎ শহর থেকে গ্রামের প্রান্তিক পরিবারকে নিখরচায় চিকিৎসা পৌঁছে দেওয়া। যে কোনও অস্ত্রোপচার-সহ জটিল ক্যানসার বা কিডনির সমস্যা, হৃদরোগ বা সেরিব্রাল স্ট্রোক রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করানো সম্ভব স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের দ্বারা।
পরিবার পিছু পাঁচ লক্ষ
কোনও কাগজ নেই। দরকার নেই নগদ টাকা। শুধুমাত্র একটি স্মার্টকার্ড দেওয়া হয় নাগরিকদের। সরকারি তথ্য বলছে, রাজ্যের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ এখনই স্বাস্থ্যসাথী পরিষেবার আওতায় এসেছেন। রাজ্যের মুখ্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যে স্বচ্ছতা ও দ্রুত পরিষেবাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাকি আড়াই কোটি অর্থাৎ রাজ্যের সব নাগরিককে স্বাস্থ্যসাথী পরিষেবার আওতায় আনা হবে। তাই মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে দ্রুত কাজ চলছে।’
স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আধিকারিকদের বক্তব্য, রাজ্যের প্রতিটি পরিবারকে বছরে পাঁচ লক্ষ টাকার বিমার আওতায় আনা হয়েছে। রাজ্যের যে কোনও বেসরকারি হাসপাতালে ক্যাশলেস চিকিৎসা করানোর সুযোগ মিলবে। পরিবারের সকলেই, এমনকী মহিলা সদস্যের বাপেরবাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির সব সদস্যই এর আওতায় আসবেন। কয়েকদিন আগে রাজ্যের সব নাগরিককে নিখরচায় এই পরিষেবা দেওয়ার ঘোষণার পর রাজ্যের প্রায় সর্বত্র ক্যাম্প করে স্বাস্থ্যসাথীর আবেদনপত্র পূরণের কাজ শুরু হয়েছে। তবে শুধুমাত্র ক্যাম্প নয়। বাড়িতে বসেই অনলাইনে আবেদন করা যায়। কেমন সেই ব্যবস্থা? আসুন জানা যাক।
ঘরে বসেই এই স্মার্টকার্ড পেতে পারেন
স্বাস্থ্যসাথী পরিষেবা পেতে সরকারি দপ্তরে গিয়ে দিনের পর দিন সময় নষ্ট করে লাইন দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। অনলাইনেও ফর্ম ফিলাপ করে স্মার্টকার্ড পাওয়া যায়। সেই কার্ডে নথিভুক্ত থাকে পরিবারের সব সদস্যর নাম, ফোন নম্বর। আবেদনকারীকে নিজের নাম, মোবাইল নম্বর, আধার কার্ড, জেলা, পুরসভা বা পঞ্চায়েত বাড়ির ঠিকানা এবং বায়োমেট্রিক তথ্য দিয়ে আবেদনপত্র পূরণ করতে হবে। একটা কথা মনে রাখতে হবে, আবেদনপত্রের উপরে ডানদিকে গ্রহীতাকে স্বাক্ষর করতে হবে। যদি খাদ্যসাথীর কার্ড থাকে তবে তাও জানাতে হবে আবেদনপত্রে।
অনলাইনে স্বাস্থ্যসাথীর কার্ড পাওয়া অত্যন্ত সহজ। দপ্তরের এক আধিকারিকের বলেন, ‘WB swasthya sathi yojana @ swasthyasathi .Gov. in অনলাইনে এই ঠিকানায় আবেদন করে নিজের নাম স্বাস্থ্যসাথী পোর্টালে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এরপর স্বাস্থ্যসাথী মোবাইল অ্যাপ ডাউনলোড করতে হবে।’ ওই আধিকারিক আরও বলেন, ‘নাম নথিভুক্ত হলেই এই পরিষেবার আওতায় আসবেন সেই ব্যক্তি।’ স্মার্টকার্ড ইস্যু করা হয় পরিবারের মহিলা সদস্যের নামে। কোনও পরিবারে মহিলা না থাকলে পুরুষের নামেই হবে কার্ড।
কারা এই পরিষেবার বাইরে
রাজ্যের যে সব নাগরিক অন্য সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা পাচ্ছেন তাঁরা স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পের বাইরে থাকবেন। কেউ যদি কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও রকম স্বাস্থ্য প্রকল্পের আওতায় চিকিৎসা খরচ পেয়ে থাকেন তারাও এই প্রকল্পের বাইরে থাকবেন। তবে কর্পোরেট স্বাস্থ্যবিমা থাকলে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা পেতে কোনও আইনি বা প্রশাসনিক বাধা নেই। অন্যদিকে যেকোনও বয়স, পেশা ও আয়ের মানুষই এই পরিষেবা পেতে পারেন।
ভিন রাজ্যে সুবিধা মিলবে?
নিয়ম অনুযায়ী একমাত্র পশ্চিবঙ্গের বাসিন্দাদের জন্য এই পরিষেবা চালু করা হয়েছে। রাজ্যের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে স্বাস্থ্যসাথী কার্ড দিয়ে এখন চেন্নাইয়ের হাসপাতালেও নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়া যাবে। রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডা. অজয় চক্রবর্তীর কথায়, ‘প্রতিবছর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা নিয়ে অসংখ্য মানুষ চেন্নাইয়ের হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যান। চেন্নাই ও দিল্লির অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স-সহ রাজ্যের বাইরে মোট ৬ টি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের সাহায্যে চিকিৎসা করানো সম্ভব হবে। স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্প রাজ্যে চালুর জন্য যেমন পৃথক সেল তৈরি হয়েছে, তেমনই স্বাস্থ্য ভবনের একটি বিভাগ শুধুমাত্র এই কাজের জন্য যুক্ত করা হয়েছে।
চেক করে নিন, নাম নথিভুক্ত হয়েছে কি না
নাম তো তোলা হয়েছে। কিন্তু কী করে বুঝবেন যে পরিবারের সব সদস্যের নাম এই স্কিমে রয়েছে ?
ব্যাপারটা খুব সোজা। আপনার মোবাইল বা ট্যাবে গুগলে গিয়ে টাইপ করুন ‘swasthya sathi’। এরপরে সার্চ করুন। দেখুন একটা সাইট আসছে। ‘swasthyasathi.gov.in’। এখানে ক্লিক করলেই স্বাস্থ্যসাথীর অফিসিয়াল পেজ চলে আসবে। এই সাইটের একটু নিচের দিকে স্ক্রল করলেই ঠিক বাম দিকে URN search নামে একটা অপশন আসবে। এখানে ক্লিক করলেই আরও একটি পেজ আসবে। সেখানে ডেটা সোর্স-এ আপনার জেলা দিয়ে সার্চ করতে হবে। সঙ্গে আপনার মোবাইল আর আধার কার্ড নম্বর দিতে হবে। দেখবেন show data অপশন আসবে। এখানে ক্লিক করলেই আপনার এবং আপনার পরিবারের নাম চলে আসবে।
ভ্রান্ত ধারণা ভাঙুন
স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্প নিয়ে আম জনতার মধ্যে বেশকিছু ভুল ধারনা তৈরি হয়েছে। কার্ড তো হলো? দরকারে পরিষেবা মিলবে তো? দপ্তরের আধিকারিকদের স্পষ্ট জবাব, সরকার নির্ধারিত বেসরকারি হাসপাতালে এই কার্ড নিয়ে কোনও অসুস্থ ব্যক্তি ভরতি হলে অবশ্যই পরিষেবা মিলবে। সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল যদি কার্ডের বিনিময়ে পরিষেবা দিতে অস্বীকার করে তবে সেই হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রাজ্য স্বাস্থ্য কমিশনের চেয়ারম্যান বিচারপতি অসীম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘কমিশনে অভিযোগ জানালে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে খবর, কার্ড জমা পড়ার একমাসের মধ্যে হাসপাতাল চিকিৎসার খরচ পেয়ে যাবে।