নির্মল ধর: বেশ কিছু বছর আগে কেরলে জন আব্রাহাম (John Abraham) নামে একজন পরিচালকের কথা শুনেছিলাম। তিনি প্রথম ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে ছবি বানিয়েছিলেন, তার সেই ছবি আমরা দেখেছি। তার সেই ছবি করার উদ্দেশ্য ছিল গ্রামে গ্রামে গিয়ে ছবিগুলো দেখানো, তিনি সেটা করেওছিলেন। আমাদের এই বাংলায় ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে ছবি করার ইতিহাস তেমন নেই, সেদিক থেকে উজ্জ্বল বসুর নতুন ছবি ‘দুধ পিঠের গাছ’ নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম! ২৪ পরগনার কোন এক নারায়ণপুর গ্রামের প্রায় হাজার জন মানুষ তাঁদের অর্থ দিয়ে এই ছবিকে বানাতে এগিয়ে এসেছেন, শুভ প্রয়াস এটা মানতে হচ্ছে। কিন্তু পরিচালক উজ্জ্বল বসু তাঁদের সেই অর্থের সঠিক ব্যবহার করতে পারলেন কি? সেই প্রশ্নটা উসকে দিল এই ছবি!
হ্যাঁ, ছবির লোকেশন হিসেবে গ্রামবাংলাকে তিনি বেছে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু সেই লোকেশনকে ব্যবহার করে বাংলার গ্রামীণ কোন বাস্তব সত্যকে কি তিনি দেখাতে পারলেন! কতটুকুই বা দেখালেন গ্রামীণ পরিবেশ! আসল গোলটা হয়েছে গল্প নির্বাচনে। আমরা দেখলাম একটা ছোট্ট কৃষক পরিবার, তিন সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটে তাঁদের। দারিদ্র নিত্য সঙ্গী হলেও সন্তানদের স্কুলে পাঠানো হয় একেবারেই আধুনিক ইউনিফর্ম পরিয়ে। বাসন্তী, লক্ষ্মী, গৌড় কারও চেহারাতেই গ্রামীণ কোন লক্ষণ নেই, বড়ই শহুরে তাদের চলা বলাও, শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী দু’জন কিছুটা গ্রাম্য। যে স্কুলটি দেখানো হল সেখানেও বেশ পরিপাটি ব্যবস্থা। আমাদের এখনকার বাংলার কোন গ্রামে এমন ক’টি শিক্ষালয় আছে সন্দেহ!
[আরও পড়ুন: কপিলদেবের আরোগ্য কামনায় শাহরুখ-রণবীর, কেমন আছেন কিংবদন্তি ক্রিকেটার?]
উজ্জ্বল বসুর ক্যামেরাম্যান তার যন্ত্রটি নিয়ে হলুদ সর্ষে খেত, বাঁশ ঝাড়, পুকুর, মেঠো রাস্তা, দিগন্তবিস্তৃত প্রকৃতি সবকিছুই দেখিয়েছেন কিন্তু সেই দেখানোয় কোন জীবন নেই শুধু আছে প্রকৃতির গ্রাম্যতা। গল্পে বলা হল বাড়ির অসুস্থ ছোট্ট ছেলে বায়না ধরে ঠাকুমার সঙ্গে সে বারাণসী যাবে। প্রায় লুকিয়েই সে রওনা হয়, ঠাকুমার পিছন পিছন ট্রেনে উঠে চলে যায়। পরে অন্য স্টেশনে ঠাকুমা নাতিকে দেখে তাকে নিয়ে নেমে যায় এক ঠিকানাহীন স্টেশনে। রাত কাটাতে হয় এক নির্জন আশ্রমে। ওদিকে বাবা-মা হারানো ছেলের খোঁজ পেয়ে চলে আসে সেই স্টেশনে। আর ঠিক তখনই গৌড় মৃত ঠাকুমাকে আশ্রমে ফেলে অন্য আর এক ট্রেনে উঠে বসে। কেন সে এমনটা করল। ঠিক বোঝা গেল না। ছবি এখানেই শেষ করে কী যে পরিচালক বলতে চাইলেন, সেটা মালুম হল না। অজানা এই প্রশ্নগুলো দর্শককে শুধু বিব্রত করবে, পরিচালক এটা কেন বুঝলেন না? শুধু ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেই সেটা সিনেমা হয় না। দরকার হয় একটা নিটোল গল্পের। সেই গল্পের সঙ্গে চরিত্রগুলোর একটা সম্পর্ক থাকা দরকার। নইলে সেটা শুধুই ছবি হয়েই থাকে সিনেমা হয় না।
‘পথের পাঁচালী’ থেকে ‘সহজপাঠের গপ্পো’ পর্যন্ত গ্রামীণ বাংলা নিয়ে যেসব ছবি হয়েছে সেখানে গল্প অবশ্যই একটা জরুরি জায়গা নিয়েছিল। এই ‘দুধ পিঠের গাছ’ ছবি কোনওভাবেই দর্শককে কোন গল্পের আভাসও দিতে পারেনি। সুতরাং দর্শক যদি হল থেকে অর্ধেক ছবি দেখেই বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে যান তাঁকে দোষ দেয়া যাবে না। উজ্জ্বল বাবুকে একটাই অনুরোধ, দয়া করে ছবি বানানো কিঞ্চিৎ শিখে তবে ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে ছবি করুন। এই ছবিতে সকলেই নতুন শিল্পী একমাত্র ব্যতিক্রম দামিনী বেণী বসু। তিনি করেছেন মায়ের চরিত্রটি। কিন্তু ব্যাটারি আর কতটাই বা পরিশ্রম করতে পারেন তাকে দেখতে গায়ের বউ মনে হলেও অভিনয়ের ব্যাপারে চিত্রনাট্য থেকে তিনি এতটুকু সাহায্য পাননি। সুতরাং সবটাই হয়েছে পন্ডশ্রম। বাকি শিশুশিল্পীদের কথা আর কীই বা বলব তারা শহুরে শিশু গ্রামীণ শিশু হয়ে ওঠার ট্রেনিংটাও পায়নি।