নির্মল ধর: রাজশেখর বসু অর্থাৎ পরশুরামের লেখা বিখ্যাত প্রহসন ‘দুস্তরি মায়া’ গল্পটিকে যে একেবারে আজকের মতো করে বর্ণনা করা যায়, শুধু সামাজিক প্রেক্ষাপটে নয়, রাজনৈতিক কোণ থেকেও, সেটা বেশ মজার ভঙ্গিতেই দেখিয়ে দিল ‘উষ্ণিক’ নাট্যদল। মূল কাহিনির পরিবর্ধন শুধু নয়, তাকে সাম্প্রতিক করে তোলার পুরো কৃতিত্ব অবশ্যই ঈশিতা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর কলমে মূল কাহিনি যেমন চিরন্তন এক সত্যকে প্রকাশ করেছে, তেমনি সংলাপ রচনায় এবং সিচুয়েশন তৈরিতে তিনি আজকের সময়কে নিয়ে এসেছেন খুবই সাবলীল ও স্বাভাবিকতার সঙ্গে। আরোপিত মনে হয়নি কখনওই। আজকের বিজেপির ‘গো’ রাজনীতি, পুরনো ইতিহাসকে ভুলিয়ে নতুন ইতিহাস লেখার জঘন্য প্রচেষ্টাকে ঈশিতা তীব্র তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণ করেছেন। ‘দুই বুড়োর রূপকথা’ নাটকে ছেড়ে কথা বলেনি আজকের রাজনীতিকদের কাটমানি খাওয়ার কথাও।
পরশুরামের গপ্পোতে দুই বুড়োর এক অস্বাভাবিক ইচ্ছে ও স্বপ্নের কথা বলা হয়েছিল। যৌবন ফিরে পেতে চেয়েছিলেন দু’জনেই। আজকের ভোগবাদী সমাজের চেহারা দেখে ফেলে আসা যৌবনে একবার ফিরে যেতে চেয়েছিলেন জগবন্ধু (কমল) এবং বন্ধু উদ্ধব (শুভাশিস) আরও একবার যৌবনের স্বাদ উপভোগ করতে।
ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমির সাহায্যে তারা ফিরেও যান আশি পিছিয়ে চল্লিশে। নতুন বয়সে পৌঁছে দক্ষিণ কলকাতার নতুন পরিবেশে এসে অচিরেই বুঝতে পারেন, চাওয়া ও পাওয়ার মধ্যে রয়েছে ভীষণ ফাঁক! যে ফাঁকের মধ্যে থেকে যায় তাঁদের অতীত, তাঁদের শারীরিক অক্ষমতা এবং নতুন সমাজের সঙ্গে নিজেদের তৈরি করতে না পারার সাধ্য। পুরাতনকে অস্বীকার করে নতুন সৃষ্টি করা যায় না। শিকড় ছাড়া যেমন গাছ বাঁচে না, তেমনি মানুষের জীবন, মানুষের সামাজিক কাঠামো, সভ্যতা – সবকিছুই পুরনোকে বাতিল করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। জীবনের চিরন্তন এই সত্যকে মঞ্চে পরশুরামের গল্পের সাহায্য নিয়ে দারুণ মজা, হাসি, মশকরা উপভোগ্য করে উপস্থিত করেছেন ঈশিতা।
[আরও পড়ুন: নজরুলের প্রতি অটল শ্রদ্ধা, বছরভর সাবান-শ্যাম্পু দিয়ে মূর্তি পরিষ্কার করেন প্রাক্তন শিক্ষক]
শুধু সংলাপ এবং পরিস্থিতি তৈরিতে নয়, নাটকটির কাঠামোর মধ্যেই সেই মজা, শুরু থেকেই ঢুকিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবতা ভেঙে ঈশিতা নিজেই মঞ্চে ঢুকে দর্শকের সঙ্গে যেভাবে বন্ধনটি তৈরি করেন, তখন থেকেই বোঝা যায় এই প্রহসন শুধুই মজাদার হবে না, থাকবে চিন্তার খোরাকও। সেটাই ঘটেছে বাকি দু’ঘণ্টা জুড়ে। নাচে-গানে, কোথাও কোথাও কিঞ্চিৎ স্থূল ভাঁড়ামির সাহায্য নিয়ে ঈশিতা পরশুরামের বক্তব্য থেকে চ্যুত না হয়েও গপ্পোটিকে আধুনিক করে তুলেছেন। পুরনো, নতুন হিন্দি ও বাংলা গানের সুরে নিজের কথা বসিয়ে বেশ মেজাজি পরিবেশ তৈরি করেছেন।
তবে হ্যাঁ, তাঁর কাজের সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন প্রধান দুই বুড়োর চরিত্রে দুই অপ্রতিদ্বন্দ্বী অভিনেতা- শুভাশিস মুখোপাধ্যায় ও কমল চট্টোপাধ্যায়কে। এঁরাই নাটকটির শিরদাঁড়া। দারুণ টাইমিং, শরীরী অভিব্যক্তি, সংলাপের মার-প্যাঁচগুলোকে সুন্দর অর্থবহ করে উপস্থিত করায় দু’জনেই অসাধারণ। শুভাশিস একটু বাড়তি নম্বর পাবেন দুটি গানে কণ্ঠদানের জন্য।
না, সে জন্য সহ-শিল্পীদের কোনওভাবেই সরিয়ে রাখছি না। বিশেষ করে গোমাতার চরিত্রে শর্মিলা মিত্র ভয়েস থ্রোয়িংয়ে জমজমাট। ব্যঙ্গমা ব্যঙ্গমীর চরিত্রে অয়ন চট্টোপাধ্যায় ও অরুণিকা রায় নাটকটির মেজাজ উপলব্ধি করেই মঞ্চে বেশ খোস মেজাজেই অভিনয় করেছেন। এঁদের বাদ দিয়ে শুভাশিস এবং কমলবাবু কিন্তু এতটা সফল হতে পারতেন না। সত্যি বলতে সামগ্রিক ভাবে “দুই বুড়োর রূপকথা” একটি সুসংবদ্ধ প্রযোজনা। জীবনের বাস্তব সত্যকে হাসির মোড়ক দিয়ে পরিবেশন মোটেই সহজ কাজ নয়। সেটা পর্দায় চ্যাপলিন প্রমাণ করে গিয়েছেন সারাজীবন। আমাদের উৎপল দত্ত মহাশয় করেছিলেন মঞ্চে। ঈশিতা তাঁদের উত্তরসূরি বলব না, কিন্তু তাঁর পথটি সেই দিকেই গেল এই নাটকের মধ্য দিয়ে।