গতবারের তুলনায় এবারের কৃষক আন্দোলন স্তিমিত, স্বভাবতই দ্বিগুণ উজ্জীবিত বিজেপির মনোবল। আন্দোলন নিয়ে নরেন্দ্র মোদিও বিচলিত নন। মিটলে ভালো, না মিটলেও ক্ষতি নেই মনোভাব। কারণ, তৃতীয়বার জয়ের বিষয়ে তিনি এতটাই আস্থাবান। বার বার হ্যাটট্রিকের কথা বলে তিনি যেমন দলের কর্মী-সমর্থকদের জয় সম্পর্কে নিশ্চিন্ত করে তুলছেন, তেমনই বিরোধীদের মনোবল খানখান করে দেওয়ার খেলাও খেলে চলেছেন। কলমে সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
তিন বছর আগের ছবির সঙ্গে এবারের মিল-অমিল খুঁজছিলাম। কৃষকদের বেশভূষা ও চালচলন একই। ‘জোশ’ ও অপরিবর্তিত। অনন্ত অবস্থানের প্রস্তুতিতেও খামতি নেই। আপাতত ছমাসের রেশন, থাকার জন্য তাঁবু, ট্রাক-ট্র্যাক্টরের জন্য ডিজেল ও অফুরন্ত মনোবল নিয়ে কৃষকেরা দাবি আদায়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষায় প্রস্তুত। স্লোগানও আগের মতো এক। পুরনো ছবির সঙ্গে অমিল চোখেই পড়ে না।
তিন বছর আগের দিল্লি অভিযানের সময় যা কিছু বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যেমন পুলিশের লাঠি, কাঁদানে গ্যাস, হাজার রকমের ব্যারিকেড, রাস্তায় পোঁতা স্পাইক বা টায়ার ফুটো করার গজাল, রাস্তা কেটে যাত্রারুদ্ধ করার ছক, সেসব এবারেও হুবহু এক। ঠিক যেন তিন বছর আগের প্রতিচ্ছবি। এবার বাড়তি বলতে শুধু ড্রোন। পুলিশ ড্রোনের সাহায্যে আকাশপথে কৃষকদের গতিবিধিই শুধু লক্ষ করছে না, কাঁদানে গ্যাসের শেলও ফাটাচ্ছে। এটা অবশ্যই চোখে পড়ার মতো একটা অমিল।
অমিল আরও আছে। আগের বারের তুলনায় এবার কৃষকদের ‘পার্টিসিপেশন’ বেশ কম। আগের বারের মতো সব সংগঠন এবার এককাট্টা নয়। যেমন, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ‘ভারতীয় কিসান ইউনিয়ন’ (বিকেইউ)। টিকায়েতরা এবার এই অভিযানে শামিল হয়নি। তাদের ভূমিকা খানিকটা ‘জলে নামছি, তবে ডুব দেব না’ গোছের।
[আরও পড়ুন: সহসা ব্রিগেড ডেকে বিরোধীদের প্রবল চাপে ফেলে দিলেন মমতা]
বিকেইউ জানিয়েছে, এই অভিযানে তারা নেই। তবে কৃষকেরা অত্যাচারিত হলে প্রতিবাদ হবে। কিন্তু এছাড়াও এবারের সবচেয়ে বড় অমিল সরকারি মানসিকতা। মনোবলের ক্ষেত্র। ২০২০-২১ সালের কৃষক আন্দোলন সরকারকে নড়িয়ে দিয়েছিল। কৃষকেরা যে ভুল করছে তা প্রমাণে সরকারের চেষ্টায় সেবার অন্ত ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে বারবার তিন কৃষি আইনের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন। অর্থনীতিবিদ ও কৃষিবিদদের দিয়েও বুঝিয়েছিলেন কেন ওই তিন আইন আখেরে কৃষকের জন্য হিতকর। কেন তা দেশের অর্থনীতির পক্ষে ভালো।
কেন সংস্কার প্রয়োজন। কিন্তু কৃষকদের জোটবদ্ধতা বাধ্য করে মোদি সরকারকে পিছু হটতে। তিনটি আইন প্রত্যাহার করা হয়। সেবার সরকার প্রবল নার্ভাস ছিল। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পিছু হটা তাই তাঁর আত্মসম্মানের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল। এবার সেই দায় নেই। তিনি চিন্তিতও নন বিন্দুমাত্র। উদ্বিগ্ন তো নন-ই। এটাই সেবার ও এবারের মধ্যে সবচেয়ে বড় অমিল। সেবার সরকার তটস্থ ছিল। ভিতর থেকে কেঁপে গিয়েছিল। এবার ভারমুক্ত।
স্মরণে রাখা দরকার, সেবার কৃষি আইনকে কেন্দ্র করেই বিজেপির দীর্ঘদিনের শরিক শিরোমণি ‘অকালি দল’ এনডিএ ছাড়ে। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের ‘সুগার বেল্ট’ দাপিয়ে বেড়িয়েছিল বিকেইউ। রাকেশ ও রাজেশ টিকায়েত জাট কৃষকদের বিজেপি-বিরোধী করে তুলেছিলেন। সমাজবাদী পার্টি ও রাষ্ট্রীয় লোকদল ভোট রাজনীতিতে আশাবাদী হয়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোটে দেখা গেল বিজেপিই ফের ক্ষমতায়!
যারা মনে করেছিল, কৃষক আন্দোলনের ঢেউ রাজ্যে প্লাবন ঘটাবে, তারা বিস্ময়ে দেখল, পশ্চিমাঞ্চলের গোটা কুড়ি আসনে জাটেরা বিজেপিকে বেগ দিলেও অন্যত্র জাতভিত্তিক জনসমর্থন বিজেপির দিকেই। ২০১৭ সালের চেয়ে ২০২২-এ বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ৫৭টি আসন কম পেলেও সরকার গড়তে যোগী আদিত্যনাথকে বেগ পেতে হয়নি। এমনকী, যে লখিমপুর খেরি জেলা গাড়ি চাপা দিয়ে কৃষক হত্যায় তোলপাড় হয়েছিল, সেখানেও বিজেপিরই জয়জয়কার। সেবারের তুলনায় এবারের কৃষক আন্দোলন অর্ধেক স্তিমিত, স্বভাবতই দ্বিগুণ উজ্জীবিত বিজেপির মনোবল। প্রধানমন্ত্রী তাই নির্বিকার।
শুধু নির্বিকার বলা ঠিক হল না, বরং বলা ভাল তৃতীয়বার জয়ের বিষয়ে তিনি এতটাই আস্থাবান যে, বার বার নানাভাবে সরকার গঠনের আগাম ঘোষণাও তিনি করে চলেছেন। পার্লামেন্টে বলেছেন। দলের কর্মসমিতির বৈঠকে বলেছেন। মায় জনসভাতেও বলে যাচ্ছেন, ‘৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপ করেছি, লোকসভায় বিজেপি ৩৭০ আসন পাবেই। জোট পাবে ৪০০।’ বিদেশসফর শেষে দেশে ফিরে সেদিন বললেন, বিদেশিরা জানতে চাইছে– জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রীয় সফরে যেতে পারব কি না। এর অর্থ একটাই, তারাও জানে ‘আয়েগা তো মোদি হি’।