সুতীর্থ চক্রবর্তী: রাহুল গান্ধীর সাংসদ পদ খারিজ হওয়ার রাজনৈতিক অভিঘাত কী, তার প্রথম ধারণা মিলবে কর্ণাটক বিধানসভা ভোটের ফলে। এই ভোট আর দূরে নেই। মে মাসেই হওয়ার কথা। কর্ণাটক ভোটের কথা মাথায় রেখেই কি রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে মানহানির মামলার রায় দ্রুত হল? সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। বিজেপি ইতিমধ্যেই রাহুল ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ‘ওবিসি’ ভোটের দিকে নিশানা করতে শুরু করেছে। তেলি সম্প্রদায়ের তরফে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষিত হয়েছে। রাহুলের করা যে-মন্তব্যে তাঁর সাংসদ পদ খারিজ হয়েছে, সেটি ওবিসি সম্প্রদায়ের ভাবাবেগকে আদৌ স্পর্শ করছে কি না, তার প্রথম ইঙ্গিত মিলতে পারে ভোটের ফলেই। মুসলিম ওবিসি (OBC) সম্প্রদায়ের ৪ শতাংশ কোটা ছাঁটাই করে কর্ণাটকের বিজেপি সরকার ভোক্কালিগা ও লিঙ্গায়েত সম্প্রদায়ের পিছিয়ে পড়াদের জন্য সংরক্ষণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। ফলে কর্ণাটকের (Karnataka) ভোট-রাজনীতিতে ওবিসি রাজনীতি এসে পড়েছে।
রাহুল-ইস্যু (Rahul Gandhi) সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কী প্রভাব ফেলতে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মত উঠে আসতে শুরু করেছে। ‘জরুরি অবস্থা’র পর ভোটে পর্যুদস্ত হয়ে তাঁর গ্রেপ্তারিকে ইস্যু করে রাহুলের ঠাকুরমা যেভাবে জাতীয় রাজনীতিতে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছিলেন, সেটা নাতির ক্ষেত্রে ঘটবে কি না, তা নিয়ে আলাপ-আলোচনা ও বিশ্লেষণ চলছে। গ্রেফতারি ইন্দিরা গান্ধীর ক্ষেত্রে সহানুভূতির হাওয়া তুলতে সহায়ক হয়েছিল। দু’-বছরের কারাদণ্ড ও সাংসদ পদ চলে যাওয়া কি একইরকমভাবে রাহুলের ক্ষেত্রেও সহানুভূতির হাওয়া তুলতে পারবে, প্রশ্ন সেখানেই। রাজনৈতিক মহলে বলা শুরু হয়েছে যে, রাহুল যদি এই মুহূর্তে আবার আরও একটি ‘ভারত জোড়ো’ (Bharat Jodo) যাত্রায় বের হন, তাহলে সহানুভূতির হাওয়া তুলতে পারবেন। এখনই সহানুভূতির হাওয়া তুললে, তা ২০২৪ সাল পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া কঠিন। তবে কর্ণাটক ভোটে সেটা কার্যকর হতে পারে। রাহুল-ইস্যুতে বিরোধীরা এককাট্টা হয়েছে। কর্ণাটক বিধানসভা (Karnataka Assembly) ভোটে বিরোধী ঐক্য বড় ফ্যাক্টর নয়।
[আরও পডুন: বাঘ মেরে পাচারের ছক? নদিয়ার সীমান্ত এলাকায় থেকে উদ্ধার বাঘের চামড়া, পলাতক দুষ্কৃতীরা]
গেরুয়া শিবির থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে, কর্ণাটকে কংগ্রেসের প্রচারের অভিমুখ যদি রাহুল-কাণ্ডর দিকে ঘুরে যায়, তাহলে রাজনৈতিক সুবিধা তাদেরই। বিজেপি চায় কর্ণাটকে ভোটের প্রচারে মেরুকরণ হোক রাহুল ও মোদির (Narendra Modi) মধ্যে। তাদের কৌশল হতে পারে, কংগ্রেস যত রাহুল-ইস্যুতে নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করবে, তত নির্বাচনী প্রচারে আড়ালে নিয়ে যাওয়া যাবে মানুষের প্রকৃত সমস্যাগুলি। মূল্যবৃদ্ধি, দুর্নীতি, অনুন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় ভোটের প্রচারে না-আসাই গেরুয়া শিবিরের কাম্য। প্রচার সরকার-বিরোধী এই ইস্যুকে ঘিরে আবর্তিত হলেও, তা বিজেপির পক্ষে স্বস্তিদায়ক হবে না। তার চেয়ে বরং প্রচারে রাহুল যত মোদি ও আদানিকে(Adani) নিশানা করবেন, তত তাদের সুবিধা হবে বলে গেরুয়া শিবিরের ধারণা। ২০১৯-এর লোকসভা (Lok Sabha 2019) ভোটে রাহুল গান্ধী মোদির বিরুদ্ধে প্রচারে হাতিয়ার করেছিলেন ‘রাফালে দুর্নীতি’ (Rafale Scame)। সেইসঙ্গে প্রচারে এসেছিল শিল্পপতি অনিল আম্বানিকে অনৈতিকভাবে সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার বিষয়টি। ভোটের ফলে দেখা গেল, রাফালে দুর্নীতি ও অনিল আম্বানির সঙ্গে মোদির ব্যক্তিগত যোগাযোগের বিষয়টি ভোটাররা সেভাবে গ্রহণ করেনি। গেরুয়া শিবির নিশ্চিত, একই ঘটনা ঘটবে হিন্ডেনবার্গ ও গৌতম আদানির ক্ষেত্রেও। সে-কারণে গেরুয়া শিবিরের তরফে রাহুলের প্রচার নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ নেই।
গেরুয়া শিবির যেভাবে ভাবছে, সেটা সঠিক কি না, তার প্রমাণ মিলবে কর্ণাটক ভোটে। সাম্প্রতিক যে বিধানসভা ভোটগুলি হয়েছে, তার ফলে মোটেও স্বস্তিতে নেই নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা (Amit Shah)। গুজরাটের ভোটের ফলকে তারা ধর্তব্যর মধ্যে রাখছে না। কারণ, গুজরাটে কংগ্রেসের অস্তিত্ব অনেক আগে থেকেই বিপন্ন ছিল। বিজেপির (BJP) কপালে ভাঁজ ফেলেছে হিমাচলের পরাজয়। যেখানে ভোট হয়েছে মূলত অর্থনৈতিক ইস্যুকে সামনে রেখে। দিল্লির পুরভোটে দেড় দশক পড়ে পরাজয়ও গেরুয়া শিবিরকে চমকে দিয়েছে।
একইরকমভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের তিন রাজ্যের ভোটের ফলও বিজেপিকে খুশি করতে পারেনি। ত্রিপুরায় (Tripura) জয় এসেছে কোনওক্রমে। বিজেপির আসন ও ভোট দুটোই কমেছে বিরাটভাবে। ত্রিপুরার রাজাকে আসরে না নামালে বিজেপির (BJP) পক্ষে জয় হাসিল করা মুশকিল ছিল। মেঘালয়ে পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকেও বিজেপি আসন ও ভোট বাড়াতে পারেনি। একই কথা প্রযোজ্য নাগাল্যান্ডের ক্ষেত্রেও। কেন্দ্রে যারা ক্ষমতায় থাকে, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি সাধারণত তাদের সঙ্গেই থাকে। ফলে আট বছরে মোদি রাজত্বে উত্তর-পূর্বে বিজেপির আরও শক্তি বিস্তার করার কথা ছিল। কিন্তু, তার উলটোটাই হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বিজেপিকে ভাবাচ্ছে। গেরুয়া শিবিরও বুঝতে পারছে আট বছরে মোদি শাসনের বিরুদ্ধে একটা হাওয়া কোথাও উঠতে শুরু করেছে। এই প্রেক্ষিতেই কর্ণাটক বিধানসভা ভোট গেরুয়া শিবিরের পক্ষে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কর্নাটকে যদি বিজেপি হারে, তাহলে ২০২৪-এর দৌড়ে সেটা তাদের কাছে একটি বিরাট ধাক্কা হবে। তাই রাহুল গান্ধীকে বিতর্কের মূল কেন্দ্রে নিয়ে আসাটা বিজেপির একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে।
[আরও পডুন: ফের প্যান-আধার সংযুক্তিকরণের সময়সীমা বাড়ছে? নয়া সিদ্ধান্তের পথে কেন্দ্র]
আদালতের রায় নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়। রাজনৈতিক সভার মন্তব্যাদি নিয়ে আগেও মামলা হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সভায় করা মন্তব্য যে এইভাবে দেশের অন্যতম বিরোধী নেতার কপালে দু’-বছরের কারাদণ্ড ডেকে আনতে পারে, তা অনেকের পক্ষেই বিশ্বাস করা কঠিন হচ্ছে। এ যেন লঘু পাপে গুরুদণ্ড। মানহানিকে একটি ‘ফৌজদারি অপরাধ’ হিসাবে দেখাটা কতটা ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচয়, তা ঘিরেও বিতর্ক উঠেছে। দেশদ্রোহিতার মতো ঔপনিবেশিক আইন থাকা উচিত কি না, সে বিষয়ে শীর্ষ আদালতে মামলা ঝুলছে। মানহানির আইনটিও ঔপনিবেশিক আমলে দেশদ্রোহিতা আইনের হাত ধরেই এসেছে। রাজ-পরিবারের বিরুদ্ধে রাজনীতি বন্ধ করতেই ওই আইন হাতিয়ার ছিল। তবে স্বাধীনতার পরে মানহানি আইনের এইরকম জোরালো অভিঘাত অতীতে দেখা যায়নি। রাহুল গান্ধীর উপর এই আইনের প্রয়োগ ভারতের রাজনীতিকে এখন কোন তিমিরে পৌঁছে দেয়, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা তুঙ্গে।