কৃষ্ণকুমার দাস, ঢাকা: দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রথম থেকে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং জামাত জোট ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছিল। হরতাল, অবরোধ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া বিরোধীদের কিছুতেই নির্বাচনে টেনে আনতে পারেননি শেখ হাসিনা। শেষে তাদের বাদ দিয়েই ভোট হয়েছে। বাধ্য হয়ে নয়া কৌশল হিসাবে দলেরই প্রায় শতাধিক হেভিওয়েট নেতাকে ‘ডামি’ প্রার্থী করে নির্দল পরিচয় দিয়ে মাঠে নামিয়েছিলেন আওয়ামি লিগ সভানেত্রী।
সরকারি ফলাফল অনুযায়ী, ২৯৯টি আসনের মধ্যে ২২২টিতে জয় পেয়েছে আওয়ামি লিগ। ক্ষমতাসীনদের পর সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা–৬২টি আসনে। বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল, এরশাদের জাতীয় পার্টি জয়ী হয়েছে ১১টি আসনে। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে বলে জানিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়াল। তাহলে বিরোধী দলের মর্যাদা কে পাবে? মাত্র ১১টি আসন নিয়ে কি বাংলাদেশের ৩৫০ আসনের সংসদে বিরোধী দল হতে পারবে এরশাদের দল? কী হবে বিরোধী দলের ভবিষ্যৎ?
এমনই এক প্রশ্নের উত্তরে সোমবার ঢাকার গণভবনে সাংবাদিকদের সরাসরি উত্তর দিয়ে পালটা প্রশ্ন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বলেন, “বিরোধী দলের কে কে প্রার্থী হবেন, কীভাবে চলবে বিরোধীরা, সে কি আমি ঠিক করে দেব? আর করে দিলেও সেই দল কি বিরোধী দলের গ্রহণযোগ্যতা পাবে? আর গণতন্ত্রে এটা কি উচিত?” এর পরই হাসিনা বলেন, “আমি নিজে বিরোধী দলে ছিলাম, গোটা বাংলাদেশ ঘুরে মানুষের জন্য আন্দোলন করেছি। সংসদে প্রশ্ন করে সরকারকে ব্যস্ত করেছি।” তার পরই নাম না করে বিএনপি-জামাতকে তুলোধোনা করে হাসিনা বলেন, “এখন যারা বিরোধী দল, এরা সন্ত্রাসীর দল। ট্রেন পুড়িয়ে মানুষ মারে, বাস পোড়ায়। ভোটে লড়ার যোগ্যতা বা সাহস কিছুই এদের নেই।”
ভোটের ফলাফল এদিন তথ্য দিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, সরকার নির্বাচনকে অধিকতর অংশগ্রহণমূলক দেখাতে ভোটে দলের সংখ্যা বাড়াতে সচেষ্ট ছিল। তবে এসব দলের অধিকাংশেরই কোনও জনসমর্থন নেই। অতীত নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী, এবার অংশগ্রহণকারী অধিকাংশ দলেরই সংসদে কখনও প্রতিনিধিত্ব ছিল না। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ২৩টির প্রার্থীরাই কোনও আসনে জিততে পারেননি। এসব দলের দু-একজন বাদে প্রায় সব প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। সর্বশেষ তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামি লিগের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে অংশ নিয়ে সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ভোট পেয়েছিল ৫ থেকে ৭ শতাংশের মধ্যে। এই তিন নির্বাচনে আওয়ামি লিগের সঙ্গে সমঝোতা ছাড়া যেসব আসনে জাতীয় পার্টি লড়েছে, সেখানে তাদের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।
১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি ১৪০টি আসন পায়। আওয়ামি লিগ ৮৮টি। ভোটের পর জামায়াতে ইসলামির সমর্থন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই ভোটে আওয়ামি লিগ ১৪৬ আসনে জিতে প্রথমবার শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামি লিগ ২৩০ আসন পেয়ে সরকার গড়ে। ২০১৮ সালের ভোটে আওয়ামি লিগ ২৫৮ আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। বিএনপি পায় ৬টি আসন। এবারের নির্বাচনে আওয়ামি লিগ ও জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিল সবচেয়ে বেশি। এর পর তৃতীয় সর্বোচ্চ ১৩৫ জন প্রার্থী ছিল নতুন নথিভুক্ত হওয়া রাজনৈতিক দল তৃণমূল বিএনপির। চতুর্থ সর্বোচ্চ ১২২ জন প্রার্থী ছিলেন ন্যাশনাল পিপলস পার্টির।
অন্যান্য দলের মধ্যে বাংলাদেশ কংগ্রেসের ৯৬, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টির ৭৯, জাসদের ৬৬, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের ৬৩ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের (বিএনএম) ৫৬ জন করে প্রার্থী ভোটে লড়াই করেছেন। কিন্তু লজ্জার কথা হল, এই ছোট দলগুলির কেউই জিততে পারেননি। সর্বশেষ সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল ৯টি দলের। কিন্তু এবার তো সবেধন নীলমনি জাতীয় পার্টি। কে হবেন বিরোধী নেতা? প্রশ্নের উত্তরে এদিন আওয়ামি লিগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদের বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীই ঠিক করবেন কে বিরোধী দলনেতা হবেন।