সুকুমার সরকার, ঢাকা: দুর্গাপুজোর (Durga Puja) ইতিহাসের কথা উঠলে প্রথমেই আসে কলকাতার নাম। কলকাতা কেন্দ্রিক দুর্গাপুজোর ইতিহাস যেভাবে জানা যায়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন বিশদভাবে তা এখনও জানা যায় না। বাংলাদেশে কীভাবে এই দুর্গাপুজো শুরু হল, তা নিয়ে নানা কাহিনি প্রচলিত। তারই একটা রাজধানী ঢাকার (Dhaka) ঢাকেশ্বরী মন্দিরের দুর্গাপুজো। বাংলাদেশের জাতীয় মন্দির হিসেবে পরিচিত রাজধানী ডাকার ‘ঢাকেশ্বরী মন্দির’। বলা হয়, আটশো বছর আগে থেকেই ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শ্রী শ্রী ঢাকেশ্বরী মন্দিরে পূজিত হন মা দুর্গা। এছাড়া শ্রীহট্টের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে পূজিত হন লালবর্ণের দেবী। এই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। গোটা উপমহাদেশে এখানেই একমাত্র রক্তবর্ণ দুর্গা। এবছরের পুজোয় সেসব প্রাচীন মন্দিরে প্রস্তুতি তুঙ্গে।
প্রথমে আসা যাক ঢাকেশ্বরী মন্দিরের (Dhakeswari Temple) পুজোর ইতিহাসে। শুরু থেকেই ঢাকেশ্বরী মন্দিরটি দুর্গা প্রতিমার স্থায়ী মন্দির। প্রথম দিকে এখানে ছিল অষ্টভুজার প্রতিমা। পরবর্তী সময় স্থাপন করা হয় দশভুজার দুর্গা প্রতিমা। ঢাকা ও তার আশেপাশের অঞ্চলগুলিতে এখনও বেশ কিছু দুর্গাপুজো প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। ১৮৩০ সালের পুরনো ঢাকার সূত্রাপুর অঞ্চলের ব্যবসায়ী নন্দলাল বাবুর মৈসুন্ডির বাড়িতে ঢাকার সবচেয়ে বড় দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাই বিপ্লবের সময় বিক্রমপুর পরগনার ভাগ্যকূল জমিদার বাড়ির রাজা ব্রাদার্স এস্টেটে এবং সাটুরিয়া থানার বালিহাটির জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়।
সেসময়ে সিদ্ধেশ্বরী জমিদার বাড়ি ও বিক্রমপুর হাউসেও জাঁকজমকপূর্ণ দুর্গাপুজোর আয়োজন করা হয়েছিল। ১৯২২-২৩ সালে ঢাকার আরমানিটোলায় জমিদার শ্রীনাথ রায়ের বাড়ির পুজোও বেশ বিখ্যাত ছিল। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পূজিতা দুর্গার আরেক রূপ দেবী ঢাকেশ্বরীর নামেই ঢাকার নামকরণ হয় বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করে থাকেন। রয়েছে সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি, রামকৃষ্ণ মিশন, রমনা কালীবাড়ি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, কলাবাগান, উত্তরা এবং বনানীর পুজোয় মিশেছে আধুনিকতার সংযোজন। এ পুজো মণ্ডপগুলিতে হিন্দুদের পাশাপাশি মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবধর্মের লোকজন আনন্দ উৎসাহে অংশ নেন। দেশের নানা প্রান্তের সব ধর্মের মানুষের এক মিলনোৎসবে পরিণত হয়েছে।
[আরও পড়ুন: মহালয়ায় বোধন, ওইদিনই ঘট নিরঞ্জন, বাংলার কোথায় একদিনের দুর্গাপুজো হয়?]
কারও কারও মতে, বাংলাদেশের উত্তরের জনপদ জেলা রাজশাহীতে প্রথম দুর্গাপুজোর শুরু হয় ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে। তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ প্রথম দুর্গাপুজোর প্রবর্তন করেন। রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন বাংলার বারো ভূঁইঞার এক ভূঁইঞা। সেসময় রাজা কংস নারায়ণ প্রভূত ভূ-সম্পত্তির অধিকারী হন। তখনকার রাজাদের মাঝে নিজের সামাজিক প্রতিপত্তি বাড়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই পুজোর আয়োজন করেন। সেসময়ের হিসেবে প্রায় আট লক্ষ টাকা ব্যয় করেন। ওই একই বছর বসন্তকালে রাজশাহীর ভাদুরিয়ার রাজা জয় জগৎ নারায়ণ বেশ জাঁকজমকভাবে বাসন্তী পুজোর আয়োজন করেন। তিনি কংস নারায়ণকে টেক্কা দেওয়ার জন্য সেই পুজোয় প্রায় নয় লক্ষ টাকা খরচ করেন। আঠারো শতকে দেশের দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার কলারোয়া থানার মঠবাড়িয়ার নবরত্ন মন্দিরে দুর্গাপুজো হতো বলে বিভিন্নজনের লেখায় পাওয়া যায়।
[আরও পড়ুন: ভগৎ সিংয়ের নামে হবে চণ্ডীগড় বিমানবন্দর, মন কি বাতে ঘোষণা মোদির]
বিংশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে দুর্গাপুজো সমাজের বিত্তশালী এবং অভিজাত হিন্দু পরিবারদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। গত শতাব্দীর শেষের দিকে এবং এই শতাব্দীর শুরুর দিকে দুর্গাপুজো তার সার্বজনীনতার রূপ পায়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর এককভাবে পুজো করাটা বেশ ব্যয়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এইসময় অভিজাত এবং বিত্তশালী হিন্দুদেরও প্রভাব-প্রতিপত্তি কমতে শুরু করে। ফলে সারা বাংলাদেশে একক দুর্গাপুজো থেকে প্রথমে বারোয়ারি এবং পরবর্তীকালে সার্বজনীন পুজোর চল শুরু হয়। সার্বজনীন হওয়ার পর থেকেই দুর্গোৎসব বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হতে শুরু করে। সার্বজনীন দুর্গা পুজো প্রচলন হওয়ার পর থেকেই সর্বস্তরের মানুষের কাছে পুজোর আকর্ষণ বৃদ্ধি পেতে থাকে।
বৃহত্তর শ্রীহট্টের মৌলভীবাজারের রাজনগর উপজেলার পাঁচগাঁওয়ে উপমহাদেশের একমাত্র লাল বর্ণের দুর্গা দেবীর পুজো হয়ে থাকে। এই পুজো প্রায় ৩০০ বছরের পুরনো। লাল রঙের মাদুর্গাকে দেখার জন্য দেশ ও দেশের বাইরের অনেক দর্শনার্থী এখানে ছুটে যান।